পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/১০০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বঙ্কিম রচনাবলী

মিশেছে সে চন্দ্রিকায়; ভাবে তার চিত্ত
শুধু সে স্বপ্নের ছায়া, অসত্য অনিতা ||
যৌবন আশার সম ফুল্ল রূপ তার।
দেখিয়া ফিরালে আঁখি, দেখি ফিরে বার ||
স্থিরা ধীরা সুকোমলা বিমলা অবলা।
সবে নব পুরিতেছে যৌবনের কলা ||
মোহন সঙ্গীতে মন বেঁধেছে যতনে।
প্রেম যেন শুনিতেছে আশার বচনে ||
বদনে ললিত রেখা কত হয়ে যায়।
রক্তিম নীরদ যেন শারদ সন্ধ্যায় ||
গলিল নয়নপদ্ম; মুগ্ধ তার মন,
প্রাণ মন জ্ঞান ধন জীবন যৌবন,
সকলি করেছে যেন গীতে সমর্পণ ||
কোথা হতে আসে সেই সুমধুর গান?
কেন তাতে এত আশা? কে হরিল প্রাণ?


ললিতা তাহার নাম-রাজার নন্দিনী।
জননী না ছিল তার, বিমাতা বাঘিনী।
রাজা বড় নিষ্ঠুর সতত দেয় জ্বালা;
গোপনে কতই কাঁদে মাতৃহীনা বালা।
দুর্জ্জনের সাথে তার বিবাহ সম্বন্ধ-
শুনে কেঁদে কেঁদে তার চক্ষু যেন অন্ধ।
মন্মথ নামেতে যুবা, সুঠাম, সুন্দর,
বচনে অমিয় ক্ষরে নারীমনোহর।
মোহিল ললিতাচিত তার দরশনে।
গোপনে বিবাহ হৈল মিলিল দুজনে।
জানিল বিবাহবার্ত্তা দুরন্ত রাজন্।
কন্যারে ডাকিয়া বলে পরুষ বচন ||
এ পুরী আঁধার কেন কর কলঙ্কিনী।
শীঘ্র যাও দেশান্তরে না হতে যামিনী ||
কাল যদি দেখি তোরে, বধিব পরাণ।
ভয়ে বালা সেই দণ্ডে করিলা প্রস্থান ||
মন্মথ লইয়া তারে তুলিল নৌকায়।
ভয়ে ভীত দুই জনে নদী বেয়ে যায় ||
পথিমধ্যে দস্যুদল আসিয়া রোধিল।
ললিতারে কাড়ি লয়ে বনে প্রবেশিল ||
অলঙ্কার কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিল তারে।
ললিতা একাকী ফিরে নদী ধারে ধারে ||
কোথায় মন্মথ গেল, তরি কোন্ ভিতে।
রজনী গভীরা তবু ভয় নাই চিতে।
এমন সময়ে শোনে সঙ্গীতের ধ্বনি।
মন্মথ গাইছে গীত বুঝিল অমনি ||
বুঝিল সঙ্কেত করে সেই প্রিয়জন,
নদীতীরে চন্দ্রালোকে বসিল তখন।
তীরেতে লাগিল তরি অতিদ্রুত হয়ে।
দেখিতে দেখিতে দুয়ে দুয়ের হৃদয়ে ||
কতই আদর করে, পেয়ে সোহাগিনী।
কতই রোদন করে কাতরা কামিনী ||



তখন ললিতা কয়, “আর জ্বালা নাহি সয়,
       পড়িয়া দস্যুর হাতে, যে দুঃখ হে পেয়েছি।
কাড়ি নিল অলঙ্কার, লাঞ্ছনা কত আমার,
       তীরে তীরে কেঁদে কেঁদে এতদূর এয়েছি ||
দেখা হবে তব সাথ, হেন নাহি জানি নাথ,
       দয়া করি কালী আজি রেখেছেন চরণে।”
পতি বলে “শুন প্রিয়ে, তোমা ধনে হারাইয়ে,
       মরিব বলিয়ে আজি, প্রবেশিনু কাননে ||
দেখিলাম দুই ধার, মহারণ্যে অন্ধকার,
       নীরবে নির্ম্মলা নদী, তার মাঝে বহিছে।
ভীষণ বিজন স্তব্ধ, নাহি জীব নাহি শব্দ,
       তরুদলে ঢুলে জলে, ঘুমাইয়া রহিছে ||
যে স্থির অরণ্য নদী, যেন বা সৃজনাবধি,
       কোন জীব কোন কীট, তথা নাহি নড়েছে।
প্রথমে যে ছিল যথা, এখনও রয়েছে তথা,
       মৃত্যুর ভীষণ ছায়া, সর্ব্বস্থানে পড়েছে ||
ভয়েতে গগন পানে, চাহিলে ভুলিনু প্রাণে,
       বিমল সুনীলকাশে, শশী হেসে যেতেছে।
ভাবিলাম প্রকৃতির, সকলি গভীর স্থির,
       শুধু এ হৃদয় কেন, এত দুঃখ পেতেছে!
মরি যদি পারিতাম, গোলে জল হইতাম,
       এ স্থির সলিলে মিশে, হৃদয় ঘুমাইত।
তথা রিপু চিন্তাহীন, রহিতাম চিরদিন,
       ললিতার দুঃখ তবে, কিসে হৃদে আইত ||



“ভাবি এ প্রকার, ছাড়িতে হুঙ্কার,
কাঁপিল কানন স্তব্ধ।
শিহরি অন্তরে, কি জানি কি ডরে,
কাঁপে হৃদি শুনি শব্দ ||
হুতাশ নাশিতে, সঙ্কেত বাঁশীতে,
গায়িলাম দুখ যত।
বাজাইয়া তায়, মরি লো তোমায়,
সঙ্কেত করেছি কত!
একবার যাই, মুরলী বাজাই,
আপনি নয়ন ঝোরে।
গলে হৃদি দুখে, এক মাত্র সুখে;
বাঁশী কি মোহিল মোরে!
গাই পরক্ষণে, দেখি নিশাবনে,
একাকিনী রূপবতী।