পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৪০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰবন্ধ-বাজালা ভাষা গম্য কোন ভাষা না থাকে, তবে যে ভাষা অধিকাংশ লোকের বোধগম্য।--তাহাতেই গ্ৰন্থ প্রাণীত হওয়া উচিত। যদি কোন লেখকের এমন উদ্দেশ্য থাকে যে, আমার গ্রন্থ দাই চারি। জন শব্দপন্ডিতে বাবকে, আর কাহারও বঝিবার প্রয়োজন নাই, তবে তিনি গিয়া দরসহ ভাষায় গ্রন্থপ্রণয়নে প্রবত্ত হউন। যে তাঁহার যশ করে করুক, আমরা কখন যশ করিব না। उनि न পাষন্ড বলিব। তিনি জ্ঞানবিতরণে প্রবত্ত হইয়া, চেস্টা করিয়া অধিকাংশ পাঠককে আপনার জ্ঞানভান্ডার হইতে দরে রাখেন। যিনি যথার্থ গ্রন্থকার, তিনি জানেন যে, পরোপকার ভিন্ন গ্রন্থপ্রণয়নের উদ্দেশ্য নাই; জনসাধারণের জ্ঞানবিদ্ধি বা চিত্তোন্নতি ভিন্ন রচনার অন্য উদ্দেশ্য নাই; অতএব যত অধিক ব্যক্তি গ্রন্থের মৰ্ম্ম গ্রহণ করিতে পারে, ততই অধিক ব্যক্তি উপকৃতততই গ্রন্থের সফলতা। জ্ঞানে মনীষামাত্রেরই তুল্যাধিকার। যদি সে সব্বজনের প্রাপ্য ধনকে, তুমি এমত দরহে ভাষায় নিবদ্ধ রাখা যে, কেবল যে কয়জন পরিশ্রম করিয়া সেই ভাষা শিখিয়াছে, তাহারা ভিন্ন আর কেহ তাহা পাইতে পারবে না, তবে তুমি অধিকাংশ মনীষাকে তাহাদিগের স্বত্ব হইতে বঞ্চিত করিলে। তুমি সেখানে বঞ্চক মাত্র। তাই বলিয়া আমরা এমত বলিতেছি না যে, বাঙ্গালার লিখন পঠন হতোমি ভাষায় হওয়া উচিত। তাহা কখন হইতে পারে না। যিনি যত চেন্টা করবেন, লিখনের ভাষা এবং কথনের ভাষা চিরকাল সর্বতন্ত্র থাকিবে। কারণ, কথনের এবং লিখনের উদ্দেশ্য ভিন্ন। কথনের উদ্দেশ্য কেবল সামান্য জ্ঞাপন, লিখনের উদ্দেশ্য শিক্ষাদান, চিত্তসঞ্চালনা। এই মহৎ উদ্দেশ্য হতোমি ভাষায় কখন সিদ্ধ হইতে পারে না। হতোমি ভাষা দরিদ্র, ইহার তত শব্দধন নাই; হা ভাষা নিস্তেজ, ইহার তেমন বাঁধন নাই; হাতোমি ভাষা অসন্দের এবং যেখানে অশ্লীল নয়, সেখানে পবিত্রতাশন্যে। হাতোমি ভাষায় কখন গ্রন্থ প্রণীত হওয়া কৰ্ত্তব্য নহে। যিনি হতোমপেচা লিখিয়াছিলেন, তাঁহার রচি বা বিবেচনার প্রশংসা করি না। টেকচাঁদি ভাষা, হাতোমি ভাষার এক পৈঠা উপর। হাস্য ও করণেরসের ইহা বিশেষ উপযোগী। সাকচ কবি বািণসি হাস্য ও করাণরসাত্মিক কবিতায় সাকচ ভাষা ব্যবহার করিতেন, গম্ভীরা এবং উন্নত বিষয়ে ইংরেজি ব্যবহার করিতেন। গম্ভীরা এবং উন্নত বা চিন্তাময় বিষয়ে টেকচাঁদি ভাষায় কুলায় না। কেন না, এ ভাষাও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র, দৰবল এবং অপরিমাডিজত। অতএব ইহাই সিদ্ধান্ত করিতে হইতেছে যে, বিষয় অনসারেই রচনার ভাষার উচ্চতা বা সামান্যতা নিদ্ধারিত হওয়া উচিত। রচনার প্রধান গণ এবং প্রথম প্রয়োজন, সরলতা এবং সপষ্টতা। যে রচনা সকলেই বঝিতে পারে, এবং পড়িবামাত্র যাহার অৰ্থ বঝা যায়, অর্থগৌরব থাকিলে তাহাই সব্বোৎকৃষ্ঠািট রচনা। তাহার পর ভাষার সৌন্দৰ্য্য, সরলতা এবং সাপস্টতার সহিত সৌন্দৰ্য্য মিশাইতে হইবে। অনেক রচনার মােখ্য উদ্দেশ্য সৌন্দৰ্য-সে। স্থলে সৌন্দয্যের অনরোধে শব্দের একটি অসাধারণতা সহ্য করিতে হয়। প্রথমে দেখিবে, তুমি যাহা বলিতে চাও, কোন ভাষায় তাহা সব্বাপেক্ষা পরিস্কাররাপে ব্যক্ত হয়। যদি সরল প্রচলিত কথাবাৰ্ত্তার ভাষায় তাহা সবাপেক্ষা সংস্পস্ট এবং সন্দর হয়, তবে কেন উচ্চভাষার আশ্রয় লইবে ? যদি সে পক্ষে টেকচাঁদ বা হাতোমি ভাষায় সকলের অপেক্ষা কাৰ্য্য সসিদ্ধ হয়, তবে তােহাঁই ব্যবহার করবে। যদি তদপেক্ষা বিদ্যাসাগর বা ভূদেববােব প্ৰদশিত সংস্কৃত বহল ভাষায় ভাবের অধিক সািপম্পটতা এবং সৌন্দয্য হয়, তবে সামান্য ভাষা ছাড়িয়া সেই ভাষার আশ্রয় লইবে। যদি তাহাতেও কাৰ্য্য সিদ্ধ না হয়, আরও উপরে উঠিবে; প্রয়োজন হইলে তাহাতেও আপত্তি নাই-নিম্পপ্রয়োজনেই আপত্তি। বলিবার কথাগালি পরিসফট করিয়া বলিতে হইবে-যতটকু বলিবার আছে, সবটাঁকু বলিবে-তত্তজন্য ইংরেজি, ফাসি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য, যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন, তাহা গ্রহণ করিবে, অশ্লীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না। তার পর সেই রচনাকে সৌন্দৰ্য্যবিশিষ্ট করিবে-কেন না, যাহা অসন্দের, মনষ্যচিত্তের উপরে তাহার শক্তি অলপ। এই উদ্দেশ্য গলি যাহাতে সরল প্রচলিত ভাষায় সিন্ধ হয়, সেই চেন্টা দেখিবে-লেখক যদি লিখিতে জানেন, তবে সে চেস্টা প্রায় সফল হইবে। আমরা দেখিয়াছি, সরল প্রচলিত ভাষা অনেক বিষয়ে সংস্কৃতিবহল ভাষার অপেক্ষা শক্তিমতী। কিন্তু যদি সে সরল প্রচলিত ভাষায় সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয়, তবে কাজে কাজেই সংস্কৃত বহল ভাষার আশ্ৰয় লইতে হইবে। প্রয়োজন হইলে নিঃসঙ্কোচে সে আশ্রয় লইবে । GA