পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৫৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্কিম রচনাবলী বাহবিল দেখিতে বাসনা থাকে, তবে অদ্যই দেখিতে পাইবে, সন্দেহ নাই। হে বাহাদুৰ্থনন্দন! বীর ব্যক্তিগণ শত্ৰাগহে অপ্রকাশ্যভাবে এবং সহৃদঙ্গহে প্ৰকাশ্যভাবে প্রবেশ করিয়া থাকেন। হে রাজন! আমরা সবকাৰ্য্যসাধনাৰ্থ শত্ৰাগহে আগমন করিয়া তদ্দত্ত পজা গ্রহণ করি না; এই আমাদের নিত্যব্রত।” কোন গোল নাই-সব কথাগালি সািপষ্ট। এইখানে অধ্যায়। শেষ হইল, আর সঙ্গে সঙ্গে ছদ্মবেশের গোলযোগটা মিটিয়া গেল। দেখা গেল যে, ছদ্মবেশের কোন মানে নাই। তারপর, পর-অধ্যায়ে কৃষ্ণ ষে সকল কথা বলিতেছেন, তাহা সম্পণেরপে ভিন্ন প্রকার। তাঁহার যে উন্নত চরিত্র এ পৰ্যন্ত দেখিয়া আসিয়াছি, সে তাঁহারই যোগ্য। পািব্ব অধ্যায়ে এবং পর-অধ্যায়ে বর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রে এত গরতের প্রভেদ যে, দই হাতের বর্ণন বলিয়া বিবেচনা করিবার আমাদের অধিকার আছে। জরাসন্ধের গহিকে কৃষ্ণ তাঁহাদের শত্রগহি বলিয়া নিন্দেশ করাতে, জরাসন্ধ বলিলেন, “আমি কোন সময়ে তোমাদের সহিত শত্রতা বা তোমাদের অপকার করিয়াছি, তাহা আমার সমরণ হয় না। তবে কি নিমিত্ত নিরপরাধে তোমরা আমাকে শত্র জ্ঞান করিতেছ?” উত্তরে, জরাসন্ধের সঙ্গে কৃষ্ণের যথার্থ যে শত্রতা, তাহাই বলিলেন। তাঁহার নিজের সঙ্গে জরাসন্ধের যে বিবাদ, তাহার কিছমাত্র উত্থাপনা করিলেন না। নিজের সঙ্গে বিবাদের জন্য কেহ। তাঁহার শত্ৰ হইতে পারে না, কেন না, তিনি সব্বত্র সমাদশী, শত্রমিত্র সমান দেখেন। তিনি পান্ডবের সািহদ এবং কৌরবের শত্ৰ, এইরূপ লৌকিক বিশ্বাস। কিন্তু বাস্তবিক মৌলিক মহাভারতের সমালোচনে আমরা ক্রমশঃ দেখিব যে, তিনি ধৰ্ম্মের পক্ষ, এবং অধমের বিপক্ষ; তদ্ভিন্ন তাঁহার পক্ষাপক্ষ কিছই নাই। কিন্তু সে কথা এখন থাক। আমরা এখানে দেখিব যে, কৃষ্ণ উপযাচক হইয়া জরাসন্ধকে আত্মপরিচয় দিলেন, কিন্তু নিজের সঙ্গে বিবাদের জন্য তাঁহাকে শত্ৰ বলিয়া নিন্দেশ করিলেন না। তবে যে মনষ্যজাতির শত্র, সে কৃষ্ণের শত্র। কেন না, আদশ পরিষ সব্বভুতে আপনাকে দেখেন, তদ্ভিন্ন তাঁহার অন্য প্রকার আত্মজ্ঞান নাই। তাই তিনি জরাসন্ধের প্রশেনর উত্তরে, জরাসন্ধ তাঁহার যে অপকার করিয়াছিল, তাহার প্রসঙ্গ মাত্র না। করিয়া সাধারণের যে অনিন্ট করিয়াছে, কেবল তাঁহাই বলিলেন। বলিলেন যে, তুমি রাজগণকে মহাদেবের নিকট বলি দিবার জন্য বন্দী করিয়াছ। তাই, যধিস্ঠিরের নিয়োগক্রমে, আমরা তোমার প্রতি সমদ্যত হইয়াছি। শত্রতাটা বঝাইয়া দিবার জন্য কৃষ্ণ জরাসন্ধকে বলিতেছেন :- “হে বহদ্রাথনন্দন! আমাদিগকেও ত্বংকৃত পাপে পাপী হইতে হইবে, যেহেতু আমরা ধৰ্ম্মমচারী এবং ধৰ্ম্মম রক্ষণে সমাথ ।” এই কথাটার প্রতি পাঠক বিশেষ মনোযোগী হইবেন, এই ভরসায় আমরা ইহা পাের অক্ষরে লিখিলাম। এখন, পরাতন বলিয়া বোধ হইলেও, কথাটা অতিশয় গরতর। যে ধৰ্ম্মম রক্ষণে ও পাপের দমনে সক্ষম হইয়াও তাহা না করে, সে সেই পাপের সহকারী। অতএব ইহলোকে সকলেরই সাধ্যমত পাপের নিবারণের চেষটা না করা অধৰ্ম্মম । “আমি ত কোন পাপ করিতেছি। না, পরে করিতেছে, আমার তাতে দোষ কি?” যিনি এইরাপ মনে করিয়া নিশিচন্ত হইয়া থাকেন, তিনিও পাপী। কিন্তু সচরাচর ধৰ্ম্মমাত্মারাও তাই ভাবিয়া নিশিচন্ত হইয়া থাকেন। এই জন্য জগতে যে সকল নরোত্তম জলমগ্রহণ করেন, তাঁহারা এই ধৰ্ম্মম রক্ষা ও পাপীনিবারণৱত গ্ৰহণ করেন। শাক্যসিংহ, যিশ, খ্রীস্ট প্রভৃতি ইহার উদাহরণ। এই বাক্যই তাঁহাদের জীবনচরিতের মািলসত্ৰ। শ্ৰীকৃষ্ণেরও সেই ব্ৰত! এই মহাবাক্য স্মরণ না রাখিলে তাঁহার জীবনচরিত বিকা না। জরাসন্ধ কংস শিশপালের বধ, মহাভারতের যন্ধে পাপডিবপক্ষে কৃষ্ণকৃত সহায়তা, কৃষ্ণের এই সকল কাৰ্য্য এই মলসমূত্রের সাহায্যেই বাবা যায়। ইহাকেই পরাণকারেরা “পথিবীর ভারহরণ” বলিয়াছেন। খ্রীস্টকৃত হউক, বদ্ধকৃত হউক, কৃষ্ণকৃত হউক, এই পাপীনিবারণ ব্রতের নাম ধৰ্ম্মপ্রচার। ধৰ্ম্মপ্রচার দই প্রকারে হইতে পারে ও হইয়া থাকে ; এক, বাক্যতঃ অর্থাৎ ধৰ্ম্মম সম্পবিন্ধীয় উপদেশের দ্বারা; দ্বিতীয়, কাৰ্য্যতঃ অর্থাৎ আপনার কাৰ্যসকলকে ধৰ্ম্মের আদশে পরিণত করণের দ্বারা। শ্ৰীমন্ট, শাক্যসিংহ ও শ্ৰীকৃষ্ণ এই দ্বিবিধ অনষ্ঠানই করিয়াছিলেন। তবে শাক্যসিংহ ও শ্ৰীস্টকৃত ধৰ্ম্মপ্রচার, উপদেশপ্রধান; কৃষ্ণকৃতু ধৰ্ম্মপ্রচার কার্য্যপ্রধান। ইহাতে কৃষ্ণেরই প্রাধানা, কেন না, বাক্য সহজ, কাৰ্য্য কঠিন এবং অধিকতর ফলোপধায়ক। যিনি কেবল মানব, তাঁহার দ্বারা ইহা সসম্পন্ন হইতে পারে কি না, সে কথা এক্ষণে আমাদের বিচাৰ্য্য নহে।

  • S8,