পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৭০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধৰ্ম্মজন্ম ইহাই আমাদের বিবেচ্য যে, ঈশ্বর অনন্ত সৌন্দর্যময়। তিনি যদি সগীশ হয়েন, তবে তাঁহার সকল গণই আছে; কেন না, তিনি সব্বময়, এবং তাঁহার সকল গণই অনন্ত। অনন্তের গণ সান্ত বা পরিমাণবিশিস্ট হইতে পারে না। অতএব ঈশ্বর অনন্তসৌন্দৰ্য্যবিশিস্ট। তিনি মহৎ, শাড়ি, প্ৰেমময়, বিচিত্র অথচ এক, সব্বাঙ্গসম্পন্ন এবং নিৰ্ব্বিকার। এই সকল গণই অপরিমেয়। অতএব এই সকল গণের সমবায় যে সৌন্দৰ্য্য, তাহাও তাঁহাতে অনন্ত। যে সকল বত্তির দ্বারা সৌন্দৰ্য অনভূত করা যায়, তাহাদিগের সম্পণে অনশীলন ভিন্ন তাঁহাকে পাইব কি প্রকারে ? অতএব বদ্ধ্যাদি জ্ঞানাডজনী বত্তির, ভক্ত্যাদি কায্যকারিণী বত্তির অনশীলন, ধৰ্ম্মের জন্য য্যেরপ প্রয়োজনীয়, চিত্তরঞ্জিনী ব্যক্তিগলির অনশীলনও সেইরােপ প্রয়োজনীয়। তাঁহার সৌন্দয্যের সমচিত। অন্যভব ভিন্ন আমাদের হৃদয়ে কখনও তাঁহার প্রতি সম্যক প্রেম বা ভক্তি জন্মিবে না। আধনিক বৈষ্ণবধৰ্ম্মেম এই জন্য কৃষ্ণোপাসনার সঙ্গে কৃষ্ণের ব্রজলীলাকীত্তনের সংযোগ হইয়াছে। শিষ্য। তাহার ফল কি সফল হইয়াছে ? গর। যে এই ব্রজলীলার প্রকৃত তাৎপৰ্য্য বঝিয়াছে, এবং যাহার চিত্ত শািন্ধ হইয়াছে, তাহার পক্ষে ইহার ফল সফল। যে অজ্ঞান, এই ব্রজলীলার প্রকৃত অৰ্থ বঝে না, যাহার নিজের চিত্ত কলাষিত, তাহার পক্ষে ইহার ফল কুফল। চিত্তশদ্ধি, অর্থাৎ জ্ঞানাতজনী, কাৰ্য্যকারিণী প্রভৃতি বত্তিগলির সমচিত অনশীলন ব্যতীত কেহই বৈষ্ণব হইতে পারে না। এই বৈষ্ণব ধৰ্ম্মম অজ্ঞান বা পাপাত্মার জন্য নহে। যাহারা রাধাকৃষ্ণকে ইন্দ্ৰিয়সখরত মনে করে, তাহারা বৈষ্ণব, নহে-পৈশাচ । সচরাচর লোকের বিশ্বাস যে, রাসলীলা অতি অশ্লীল ও জঘন্য ব্যাপার। কালে লোকে রাসলীলাকে একটা জঘন্য ব্যাপারে পরিণত করিয়াছে। কিন্তু আদৌ ইহা ঈশ্বরোপাসনা মাত্র, অনন্ত সন্দিরের সৌন্দয্যের বিকাশ এবং উপাসনা মাত্র; চিত্তরঞ্জিনী বত্তির চরম অনশীলন, চিত্তরঞ্জিনী বত্তিগালিকে ঈশ্বরমখী করা মাত্র। প্রাচীন ভারতে সত্ৰীগণের জ্ঞানমােগ নিষিদ্ধ; কেন না, বেদাদির অধ্যয়ন নিষিদ্ধ। সত্ৰীলোকের পক্ষে কৰ্ম্মম মাগ কম্পটসাধ্য, কিন্তু ভক্তিতে তাহাদের বিশেষ অধিকার। ভক্তি, বলিয়াছি-“পরান-রক্তিরীশ্বরে।” অন্যরাগ নানা কারণে জন্মিতে পারে; কিন্তু সৌন্দষ্যের মোহঘটিত যে অন্যরাগ, তাহা মনষ্যে সব্বাপেক্ষা বলবান। অতএব অনন্ত সন্দিরের সৌন্দয্যের বিকাশ ও তাহার আরাধনাই অপরের হউক বা না হউক, সত্ৰীজাতির জীবনসার্থকতার মােখ্য উপায়। এই তত্ত্বাত্মক র্যাপকই রাসলীলা। জড় প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দয্য তাহাতে বৰ্ত্তমান; শরৎকালের পণচন্দ্র, শরৎপ্রবাহপরিপািণা শ্যামসলিলা যমনা, প্রস্ফটিত কুসমসবাসিত কুঞ্জবিহঙ্গমকাজিত বান্দাবনবনস্থলী জড়প্রকৃতি মধ্যে অনন্ত সন্দিরের সশরীরে বিকাশ। তাহার সহায় বিশ্ববিমোহিনী বংশী। এইরুপ সব্বপ্রকার চিত্তরঞ্জনের দ্বারা সত্ৰীজাতির ভক্তি উদ্রিক্ত হইলে তাহারা কৃষ্ণানরাগিনী হইয়া কৃষ্ণে তন্ময়তা প্রাপ্ত হইল; আপনাকেই কৃষ্ণ বলিয়া জানিতে লাগিল,- কৃষ্ণে বিরাদ্ধহীদয়া ইন্দমাচুঃ পরস্পরম। কৃষ্ণোহ হমেতল্ললিতং ব্রজম্যাক্যতং গতিং ॥ অন্যা ব্ৰবীতি কৃষ্ণস্য মম গীতিনি শাম্যতাং । দষ্ট কালিয! তিস্ঠাত্র কৃষ্ণোহহমিতি চাপরা। বাহমাসেফাট্য কৃষ্ণস্য লীলাসব্ব সবমাদদে ৷ অন্যা ব্ৰবীতি ভো গোপা নিঃশওৈকঃ স্থীয়তামহ । অলং বান্টিভয়েনাত্র ধতো গোবদ্ধ নো ময়া ৷ ইত্যাদি জীবাত্মা ও পরমাত্মার যে অভেদজ্ঞান, জ্ঞানের তাহাই চিরোদ্দেশ্য। মহাজ্ঞানীও সমস্ত জীবন ইহার সন্ধানে ব্যয়িত করিয়াও ইহা পাইয়া উঠেন না। কিন্তু এই জ্ঞানহীনা গোপকন্যাগণ কেবল জগদীশ্বরের সৌন্দয্যের অন্যরাগিণী হইয়া (অর্থাং আমি যাহাকে চিত্তরঞ্জিনী বত্তির অনশীলন বলিতেছি, তাহার সব্বোচ্চ সোপানে উঠিয়া) সেই অভেদজ্ঞান প্রাপ্ত হইয়া ঈশ্বরে বিলীন হইল। রাসলীলা রূপকের ইহাই স্থলে তাৎপৰ্য্য এবং আধনিক বৈষ্ণবধৰ্ম্মও সেই পথগামী। অতএব মনীষীদ্ধে, মনয্যেজীবনে, এবং হিন্দী ধৰ্ম্মে, চিত্তরঙ্গিনী বত্তির কত দীর আধিপত্য বিবেচনা কর।

  • 也初