পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/১৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কপালকুন্ডলা হইল বটে, কিন্তু সঙিগগণ যে তাঁহাকে একেবারে পরিত্যাগ কাঁইটীয়া গিয়াছে, এমত বোধ হইল না। বিবেচনা করিলেন, জলোচ্ছবাসে সৈকতভূমি পলাবিত হওয়ায় তাঁহারা নিকটস্থ অন্য কোন স্থানে নৌকা রক্ষা করিয়াছেন, শীঘ্র তাঁহাকে সন্ধান করিয়া লইবেন। এই প্রত্যাশায় কিয়ৎক্ষণ তথায় বসিয়া প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন; কিন্তু নৌকা আইল না। নৌকারোহীও কেহ দেখা দিল না। নবকুমার ক্ষধায় অত্যন্ত পীড়িত হইলেন। আর প্রতীক্ষা করিতে না পারিয়া, নৌকার সন্ধানে নদীর তীরে তীরে ফিরিতে লাগিলেন। কোথাও নৌকার সন্ধান পাইলেন না, প্রত্যাবিত্তন করিয়া পািকবস্থিানে আসিলেন। তখন পয্যন্ত নৌকা না দেখিয়া বিবেচনা করিলেন, জোয়ারের বেগে নৌকা ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে; এখন প্রতিকােল স্রোতে প্রত্যাগমন করিতে সওগীদিগের কাজেকাজেই বিলম্ব হইতেছে। কিন্তু জোয়ারও শেষ হইল। তখন ভাবিলেন, প্রতিকােল স্রোতের বেগাধিক্যবশতঃ জোয়ারে নৌকা ফিরিয়া আসিতে পারে নাই; এক্ষণে ভাঁটায় অবশ্য ফিরিয়া আসিতেছে। কিন্তু ভাঁটাও ক্লামে অধিক হইল—ক্রমে ক্ৰমে বেলাবসান হইয়া আসিল; সােয্যাসত হইল। যদি নৌকা ফিরিয়া আসিবার হইত, তবে এতক্ষণ ফিরিয়া আসিত। তখন নবকুমারের প্রতীতি হইল যে, হয় জলোচ্ছ বাসসম্ভূত তরঙ্গে নৌকা জলমগন হইয়াছে, নিচেৎ সঙিগগণ তাঁহাকে এই বিজনে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে। নবকুমার দেখিলেন যে, গ্রাম নাই, আশ্রয় নাই, লোক নাই, আহায্য নাই, পেয় নাই; নদীর জল অসহ্য লবণাত্মক ; অথচ ক্ষধা-তৃষ্ণায় তাঁহার হৃদয় বিদীণ হইতেছিল। দর্যন্ত শীতনিবারণজন্য আশ্রয় নাই, গাত্রবস্ত্ৰ পৰ্যন্ত নাই। এই তুষার-শীতল-বায়-সঞ্চারিত-নদী-তীরে, হিমবষী আকাশতলে, নিরাশ্রয়ে নিরাবরণে শয়ন করিয়া থাকিতে হইবেক। রাত্রিমধ্যে ব্যাঘ্র ভল্লকের সাক্ষাৎ পাইবার সম্ভাবনা। প্ৰাণনােশই নিশ্চিত। মনের চাঞ্চল্যহেতু নবকুমার এক সন্থানে অধিকক্ষণ বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। তীর ত্যাগ করিয়া উপরে উঠিলেন। ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। ক্লামে অন্ধকার হইল। শিশিরাকাশে নক্ষত্রমণ্ডলী নীরবে ফাটিতে লাগিল, যেমন নবকুমারের সবদেশে ফটিতে থাকে, তেমনি ফাটিতে লাগিল। অন্ধকারে সববত্র জনহীন ;—আকাশ, প্রান্তর, সমদ্র, সৰ্ব্বত্র নীরব, কেবল আবিরল কল্লোলিত সমদ্রগডজনি আর কদাচিৎ বন্য পশতুর রব। তথাপি নবকুমার সেই অন্ধকারে, হিমবষী আকাশতলে বালকাস্তাপের চতুঃপাশে বর্ণ ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। কখনও উপত্যকায়, কখনও অধিত্যকায়, কখনও সত্যপতলে, কখনও সতথপশিখরে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। চলিতে চলিতে প্রতি পদে হিংস্র পাশ কর্তৃক আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনা। কিন্তু এক স্থানে বসিয়া থাকিলেও সেই আশঙকা । ভ্ৰমণ করিতে করিতে নবকুমারের শ্রম জন্মিল। সমস্ত দিন অনাহার ; এজন্য অধিক অবসন্ন হইলেন। এক স্থানে বালিয়াড়ির পাশেব পােঠরক্ষা করিয়া বসিলেন। গাহের সংখতপত শয্যা মনে পড়িল। যখন শারীরিক ও মানসিক ক্লেশের অবসাদে চিন্তা উপস্থিত হয়, তখন কখনও কখনও নিদ্ৰা আসিয়া সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হয়। নবকুমার চিন্তা করিতে করিতে তন্দ্রাভিভূত হইলেন। বোধ হয় যদি এরপ নিয়ম না থাকিত, তবে সাংসারিক ক্লেশের অপ্রতিহত বেগ সকলে সকল সময়ে সহ্য করিতে পারিত না। চতুর্থ পরিচ্ছেদ ঃ সতীপশিখরে “—সবিসময়ে দেখিলা আদরে, ভীষণ-দর্শন মাত্তি ।” भयवाद যখন নবকুমারের নিদ্রাভওগ হইল, তখন রজনী গভীরা। এখনও যে তাঁহাকে ব্যান্ত্রে হত্য করে নাই, ইহা তাঁহার আশ্চৰ্য্য বোধ হইল। ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলেন, ব্যাঘ আসিতেছে কি না। অকস্মাৎ সম্মখে বহা দরে, একটা আলোক দেখিতে পাইলেন । পাছে ভ্ৰম জন্মিয়া থাকে, এজন্য নবকুমার মনোভিনিবেশপাকবািক তৎপ্রতি দলিট করিতে লাগিলেন। আলোকপরিধি ক্ৰমে বন্ধিতায়তন এবং উত্তজবলতর হইতে লাগিল—আগে নয় আলোক S8S