পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/১৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কপালকুণডলা প্রধান ব্যক্তিকে নিমন্ত্ৰণ করিয়া গহে আনিলেন। সেই দিন মেহের-উন্নিসার সহিত সেলিমের সাক্ষাৎ হইল এবং সেই দিন সেলিম মেহের-উন্নিসার নিকট চিত্ত রাখিয়া গেলেন। তাহার পর যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা ইতিহাসপাঠকমাত্রেই অবগত আছেন। শের আফগান নামক একজন মহাবিক্ৰমশালী ওমরাহের সহিত কোষাধ্যক্ষের কন্যার সম্প্ৰবন্ধ পকেবই হইয়াছিল। সেলিম অন্যরাগান্ধ হইয়া সে সম্মবন্ধ রহিত করিবার জন্য পিতার নিকট যাচমান হইলেন। কিন্তু নিরপেক্ষ পিতার নিকট কেবল তিরস্কৃত হইলেন মাত্র। সতরাং সেলিমকে আপাততঃ নিরস্ত হইতে হইল। আপাততঃ নিরস্ত হইলেন বটে, কিন্তু আশা ছাড়িলেন না। শের আফগানের সহিত মেহের-উন্নিসার বিবাহ হইল। কিন্তু সেলিমের চিত্তব্যত্তি সকল লৎফ-উন্নিসার নখদপণে ছিল ;–তিনি নিশ্চিত বঝিয়াছিলেন যে, শের আফগানের সহস্ৰ প্ৰাণ থাকিলেও তাঁহার নিস্তার নাই, আকবর শাহের মােত্যু হইলেই তাঁহার প্রাণান্ত হইবে—মেহের-উন্নিসা সেলিমের মহিষী হইবেন। লৎফ-উন্নিসা সিংহাসনের আশা ত্যাগ করিলেন। মহম্মদীয় সম্রাট কুলগৌরব আকবরের পরমায় শেষ হইয়া আসিল। যে প্রচন্ড সায্যের প্রভায় তুরকী হইতে ব্ৰহ্মপত্র পয্যন্ত প্ৰদীপত হইয়াছিল, সে সয্যে অস্তগামী হইল। এ সময়ে লৎফ-উন্নিসা তুমাত্মপ্রাধান্য রক্ষার জন্য এক দঃসাহসিক সঙ্কলপ করিলেন। রাজপ-তপতি রাজা মানসিংহের ভগিনী সেলিমের প্রধানা মহিষী। খস্র তাঁহার পত্র। এক দিন তাঁহার সহিত আকবর শাহের পীড়িত শরীর সম্বন্ধে লৎফ-উন্নিসার কথোপকথন হইতেছিল : রাজপত্যকন্যা এক্ষণে বাদশাহ পত্নী হইবেন, এই কথার প্রসঙ্গ করিয়া লৎফ-উন্নিসা তাঁহাকে অভিনন্দন করিতেছিলেন, প্রত্যুত্তরে খস্রর জননী কহিলেন, “বাদশাহের মহিষী হইলে মনকেষ্যজন্ম সাৰ্থক বটে, কিন্তু যে বাদশাহ-জননী, সেই সব্বোপরি।” উত্তর শনিবামাত্র এক অপবব চিন্তিত অভিসন্ধি লৎফ-উন্নিসার হৃদয়ে উদয় হইল। তিনি প্রত্যুত্তরে কহিলেন, “তাহাই হউক না কেন ? সেও ত আপনার ইচ্ছাধীন।” বেগম কহিলেন, “সে কি ? “ চতুরা উত্তর করিলেন, “যদুবরাজপত্র খস্রকে সিংহাসন দান করবেন।” বেগম কোন উত্তর করিলেন না। সে দিন এ প্রসঙ্গ পািনরন্থাপিত হইল না, কিন্তু কেহই এ কথা ভুলিলেন না। স্বামীর পরিবত্তে পত্র যে সিংহাসনারোহণ করেন, ইহা বেগমের অনভিমত নহে; মেহের-উন্নিসার প্রতি সেলিমের অন্যরাগ লৎফ-উন্নিসার যেরাপ হৃদয়শেল, বেগমেরও সেইরােপ। মানসিংহের ভগিনী আধনিক তুকিমান কন্যার যে আজ্ঞানিবেত্তিানী হইয়া থাকিবেন, তাহা ভাল লাগিবে কেন ? লৎফ-উন্নিসারও এ সঙকলেপ উদ্যোগিনী হইবার গাঢ় তাৎপৰ্য্য ছিল। অন্য দিন পনেকবার এ প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইল। উভয়ের মত স্থির হইল। সেলিমকে ত্যাগ করিয়া খস্রকে আকবরের সিংহাসনে সন্থাপিত করা অসম্পভাবনীয় বোধ হইবার কোন কারণ ছিল না। এ কথা লৎফ-উন্নিসা বেগমের বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম করাইলেন। তিনি কহিলেন, “মোগলেব সাম্রাজ্য রাজপতের বাহবিলে স্থাপিত রহিয়াছে; সেই রাজপতজাতির চড়া রাজা মানসিংহ, তিনি খস্রর মাতুল ; আর মসলমানদিগের প্রধান খাঁ আজিম, তিনি প্রধান রাজমন্ত্রী, তিনি খস্রর শবশরি ; ইহারা দই জনে উদ্যোগী হইলে, কে ইহাদিগের অন্যবিত্তীর্ণ না হইবে ? আর কাহার বলেই বা যদুবরাজ সিংহাসন গ্রহণ করিবেন ? রাজা মানসিংহকে এ কায্যে ব্ৰতী করা, আপনার ভার। খাঁ আজিম ও অন্যান্য মহম্মদীয় ওমরাহগণকে লিপ্তত করা আমার ভার। আপনার আশীৰ্ব্ববাদে কৃতকাৰ্য্য হইব, কিন্তু এক আশঙ্কা, পাছে সিংহাসন আরোহণ করিয়া খস্র এ দশচারিণীকে পরবহিস্কৃত করিয়া দেন।” বেগম সহচরীর অভিপ্রায় বঝিলেন। হাসিয়া কহিলেন, “তুমি আগ্ৰায় যে ওমরাহের গহিণী হইতে চাও, সেই তোমার পাণিগ্রহণ করিবে। তোমার স্বামী পঞ্চ হাজারি মনসবদার হইবেন।” লৎফ-উন্নিসা সন্তুষ্ট হইলেন। ইহাই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। যদি রাজপরীমধ্যে সামান্য পরস্ত্ৰী হইয়া থাকিতে হইল, তুবে প্রতিপাল্পবিহারিণী মধ্যকরীর পক্ষচ্ছেদন করিয়া কি সখি হইল ? যদি স্বাধীনতা ত্যাগ করিতে হইল, তবে বাল্যাসখী মেহের-উন্নিসার দাসীত্বে কি সখি ? তাহার অপেক্ষা কোন প্রধান রাজপরিষের সব্বময়ী ঘরণী হওয়া গৌরবের বিষয়। শধ এই লোভে লৎফ-উন্নিসা এ কম্পেম প্রবত্ত হইলেন না। সেলিম যে তাঁহাকে উপেক্ষা করিয়া মেহের-উন্নিসার জন্য এত ব্যস্ত, ইহার প্রতিশোধও তাঁহার উদ্দেশ্য। 'n W \SO