পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৩১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

, বিষবক্ষ সন্ধান পাইব।” কিন্তু যখন দই তিন ঘণ্টা অতীত হইল, অথচ সােয্যমখনীর কোন সংবাদ পাওয়া গেল না, তখন নগেন্দ্র স্বয়ং তাঁহার সন্ধানে বাহির হইলেন। কিছশক্ষণ রৌদ্ৰে পড়িয়া মনে করিলেন, “আমি খাজিয়া বেড়াইতেছি, কিন্তু হয়ত সহেযািমদুখীকে এতক্ষণ বাড়ী আনিয়াছে।” এই বলিয়া ফিরিলেন। বাড়ী আসিয়া দেখিলেন, সােয্যমখীর কোন সংবাদ নাই। আবার বাহির হইলেন। আবার ফিরিয়া বাড়ী আসিলেন। এইরনুপে দিনমান গেল। বস্তুতঃ শ্ৰীশচন্দ্ৰ যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা সত্য। সােয্যমখী কখনও পদব্রজে বাটীর বাহির হয়েন নাই। কতদাের। যাইবেন ? বাৰ্টী হইতে অন্ধ ক্লোশ দরে একটা পঙ্করিণীর ধারে আমবাগানে শয়ন করিয়াছিলেন। একজন খানসামা, যে অন্তঃপরে যাতায়াত করিত, সেই সন্ধান করিতে করিতে সেইখানে আসিয়া তাঁহাকে দেখিল। চিনিয়া বলিল, “আৰ্জেজ্ঞ, আসন!” সােয্যমখনী কোন উত্তর করিলেন না। সে আবার বলিল, “আজ্ঞে আসন ! বাড়ীতে সকলে বড় ব্যস্ত হইয়াছেন।” সােয্যমখনী তখন ক্ৰোধাভরে কহিলেন, “আমাকে ফিরাইবার তুই কে ?” খানসামা ভীত হইল। তথাপি সে দাঁড়াইয়া রহিল। সােয্যমখনী তাহাকে কহিলেন, “তুই যদি এখানে দাঁড়াইবি, তবে এই পঙ্করিণীর জলে আমি ডুবিয়া মরিব।” খানসামা কিছল করিতে না পারিয়া দ্রুত গিয়া নগেন্দ্রকে সংবাদ দিল। নগেন্দ্র শিবিকা লইয়া স্বয়ং সেইখানে আসিলেন। কিন্তু তখন আর সৰ্য্যেমখীকে সেখানে পাইলেন না। নিকটে অন্যসন্ধান করিলেন, কিন্তু কিছই হইল না। সােয্যমখী সেখান হইতে উঠিয়া গিয়া এক বনে বসিয়াছিলেন। সেখানে এক বাড়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল। বাড়ী কাঠ কুড়াইতে আসিয়াছিল—কিন্তু সহেযািমদুখীর সন্ধান দিতে পারিলে ইনাম পাওয়া যাইতে পারে, অতএব সেও সন্ধানে ছিল। সােয্যমখনীকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হ্যাঁ গা, তুমি কি আমাদের মা ঠাকুরাণী গা ?” সােয্যমখনী বলিলেন, “না বাছা!” বাড়ী বলিল, “হাঁ, তুমি আমাদের মা ঠাকুরাণী।” সত্যািমদুখী বলিলেন, “তোমাদের মা ঠাকুরাণী কে গা ?” বাড়ী বলিল, “বাবদের বাড়ীর বউ গা।” সােয্যমখনী বলিলেন, “আমার গায়ে কি সোণা-দানা আছে যে, আমি বাবদের বাড়ীর বউ ?” বাড়ী ভাবিল, “তাও ত বটে ?” সে তখন কাঠ কুড়াইতে কুড়াইতে অন্য বনে গেল। দিনমান এইরনুপে ব্যথায় গেল। রাত্রেও কোন ফললাভ হইল না। তৎপরদিন ও তৎপরদিনও কাৰ্য্যসিদ্ধি হইল না—অথচ অন্যসন্ধানেরও এটি হইল না। পরিষ অন্যসন্ধানকারীরা প্রায় কেহই সােয্যমখনীকে চিনিত না—তাহারা অনেক কাণ্ডগাল গরীব ধরিয়া আনিয়া নগেন্দ্রের সম্পম খে উপস্থিত করিল। শেষে ভদ্রলোকের মেয়েছেলেদের একা পথে ঘাটে সনান করিতে যাওয়া দায় ঘটিল। একা দেখিলেই নগেন্দ্রের নেমকহালাল হিন্দ স্থানীরা “মা ঠাকুরাণী” বলিয়া পাছ লাগিত, এবং স্নান বন্ধ করিয়া অকস্মাৎ পালকী, বেহােরা আনিয়া উপস্থিত করিত। অনেকে কখন পালকী চড়ে নাই, সবিধা পাইয়া বিনা ব্যয়ে পালকী চড়িয়া লইল । শ্ৰীশচন্দ্র আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। কলিকাতায় গিয়া অনসন্ধান আরম্ভ করিলেন। কমলমণি, গোবিন্দপরে থাকিয়া অনসন্ধান করিতে লাগিলেন। একত্রিংশতত্তম পরিচ্ছেদ ঃ সকল সখেরই সীমা আছে কুন্দনন্দিনী যে সখের আশা করিতে কখন ভরসা করেন নাই, তাঁহার সে সখি হইয়াছিল। তিনি নগেন্দ্রের সত্ৰী হইয়াছিলেন। যে দিন বিবাহ হইল, কুন্দনন্দিনী মনে করিলেন, এ সখের সীমা নাই, পরিমাণ নাই। তাহার পর সােয্যমখী পলায়ন করিলেন। তখন মনে পরিতাপ হইল—মনে করিলেন, “সােয্যমখী আমাকে অসময়ে রক্ষা করিয়াছিল—নহিলে আমি কোথায় যাইতাম—কিন্তু আজি সে আমার জন্য গািহত্যাগী হইল। আমি সখী না হইয়া, মরিলে ভাল ছিল।” দেখিলেন, সখের সীমা আছে। প্রদোষে নগেন্দ্ৰ শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন—কুন্দনন্দিনী শিয়রে বসিয়া ব্যজন করিতেছেন। ○>>