পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৩১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবক্ষ ত্ৰিয়ন্ত্রিংশতত্তম পরি ঃ ভালবাসার চিহ্নস্বরাপ কাপাসবসত্ৰমধ্যস্থ তপত অঙগারের ন্যায়, দেবেন্দ্রের নিরপেম মাত্তি হীরার অন্তঃকরণকে সতরে সতরে দগধ করিতেছিল। অনেক বার হীরার ধৰ্ম্মম ভীতি এবং লোকলজজা প্রণয়বেগে ভাসিয়া যাইবার উপক্ৰম হইল; কিন্তু দেবেন্দ্রের স্নেহহীন ইন্দ্রিয়পর চরিত্র মনে পড়াতে আবার তাহা বদ্ধমতল হইল। হীরা চিত্তসংযমে বিলক্ষণ ক্ষমতাশালিনী এবং সেই ক্ষমতা ছিল বলিয়াই, সে বিশেষ ধৰ্ম্মমভীতা না হইয়াও এ পয্যন্ত সতীত্বধৰ্ম্মম সহজেই রক্ষা করিয়াছিল। সেই ক্ষমতাপ্রভাবেই, সে দেবেন্দ্রের প্রতি প্রবলানরাগ অপাত্ৰন্যস্ত জানিয়া সহজেই শমিত করিয়া রাখিতে পারিল। বরং চিত্তসংযমের সদ্যপায়স্বরপ হীরা স্থির করিল যে, পনেকবার দাসীবত্তি অবলম্বন করিবে। পরগাহের গাহকৰ্ম্মাদিতে অনাদিন নিরত থাকিলে, সে অন্যমনে এই বিফলানীরাগের বশিচকদংশনস্বরােপ জবালা ভুলিতে পরিবে। নগেন্দ্র যখন কুন্দনন্দিনীকে গোবিন্দপরে রাখিয়া পৰ্যটনে যাত্ৰা করিলেন, তখন হীরা ভূতপািব্ব আনােগাত্যের বলে দাসীত্ব ভিক্ষা করিল। কুন্দের অভিপ্রায় জানিয়া নগেন্দ্র হীরাকে কুন্দনন্দিনীর পরিচর্য্যায় নিযক্ত রাখিয়া গেলেন। হীরার পনেকবার দাসীবত্তি স্বীকার করার আর একটি কারণ ছিল। হীরা পর্বে অর্থাদি কামনায়, কুন্দকে নগেন্দ্রের ভবিষ্যৎ প্রিয়তমা মনে করিয়া স্বীয় বশীভূত করিবার জন্য যত্ন পাইয়াছিল। ভাবিয়াছিল, নগেন্দ্রের অর্থ কুন্দের হস্তগত হইবে, কুন্দের হস্তগত অর্থ হীরার হইবে। এক্ষণে সেই কুন্দ নগেন্দ্রের গহিণী হইল। অর্থ সম্পবন্ধে কুন্দের কোন বিশেষ আধিপত্য জন্মিল না, কিন্তু এখন সে কথা হীরারও মনে সথান পাইল না। হীরার অর্থে আর মন ছিল না, মন থাকিলেও কুন্দ হইতে লব্ধ অৰ্থ বিষ তুল্য বোধ হইত। হীরা, আপনি নিৰ্ম্মফল প্রণয়যন্ত্রণা সহ্য করিতে পারিত, কিন্তু কুন্দনন্দিনীর প্রতি দেবেন্দ্রের অনরোগ সহ্য করিতে পারিল না। যখন হীরা শানিল যে, নগেন্দ্র বিদেশ পরিভ্রমণে যাত্রা করিবেন, কুন্দনন্দিনী গহে গহিণী হইয়া থাকিবেন, তখন হরিদাসী বৈষ্ণবীকে সমরণে হীরার মহাভয়সঞ্চার হইল। হীরা, হরিদাসী বৈষ্ণবীর যাতায়াতের পথে কাঁটা দিবার জন্য প্রহরী হইয়া আসিল । হীরা কুন্দনন্দিনীর মঙ্গলকামনা করিয়া এরােপ অভিসন্ধি করে নাই। হীরা ঈর্ষাবশতঃ কুন্দের উপর এরপ জাতক্ৰোধ হইয়াছিল যে, তাহার মঙ্গল চিন্তা দরে থাকুক, কুন্দের নিপাত দলিট করিলে পরমাহমাদিত হইত। পাছে কুন্দের সঙ্গে দেবেন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়, এইরােপ ঈষ্যাজাত ভয়েই হীরা নগেন্দ্রের পত্নীকে প্রহরাতে রাখিল । হীরা দাসী কুন্দের এক যন্ত্রণার মাল হইয়৷ উঠিল। কুন্দ দেখিল, হীরার সে যত্ন, মমতা বা প্রিয়বাদিনীত্ব নাই। দেখিল যে, হীরা দাসী হইয়া তাহার প্রতি সব্বদা অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে এবং তিরস্কৃত ও অপমানিত করে। কুন্দ নিতান্ত শান্তস্বভাব ; হীরার আচরণে নিতান্ত পীড়িত হইয়াও কখনও তাঁহাকে কিছল বলিত না। কুন্দ শীতলপ্রকৃতি, হীরা উগ্রপ্রকৃতি। এজন্য কুন্দ প্রভুপত্নী হইয়াও দাসীর নিকট দাসীর মত থাকিতে লাগিল, হীরা দাসী হইয়াও প্রভুপত্নীর প্রভু হইয়া বসিল। পরিবাসিনীরা কখনও কখনও কুন্দের যন্ত্রণা দেখিয়া হীরাকে তিরস্কার করিত, কিন্তু বাঙাময়ী হীরার নিকট তাল ফাঁদিতে পারিত না। দেওয়ানজী, এ সকল বত্তান্ত শনিয়া, হীরাকে বলিলেন, “তুমি দরি হও । তোমাকে জবাব দিলাম।” শনিয়া হীরা রোষবিস্তফারিতলোচনে দেওয়ানজীকে কহিল, “তুমি জবাব দিবার কে ? আমাকে মানিব রাখিয়া গিয়াছেন। মানিবের কথা নাহিলে আমি যাইব না। আমাকে জবাব দিবার তোমার যে ক্ষমতা, তোমাকে জবাব দিবার আমারও সে ক্ষমতা।” শনিয়া দেওয়ানজী অপমানভয়ে দিবতীয় বাক্যব্যয় করিলেন না। হীরা আপন জোরেই রহিল। সােয্যমখী নহিলে কেহ হীরাকে শাসিত করিতে পারিত না। এক দিন। নগেন্দ্র বিদেশ যাত্রা করিলে পর, হীরা একাকিনী অন্তঃপারসন্নিহিত পক্ষেপাদ্যানে লতামন্ডপে শয়ন করিয়াছিল। নগেন্দ্র ও সােয্যমখী পরিত্যাগ করা অবধি সে সকল লতামন্ডপ হীরারই অধিকারগত হইয়াছিল। তখন সন্ধ্যা অতীত হইয়াছে। আকাশে প্রায় পৰ্ণচন্দ্ৰ শোভা করিতেছে। উদ্যানের ভাসম্বর বক্ষপত্রে তৎকিরণমালা প্ৰতিফলিত হইতেছে। লতাপল্লবরন্ধ্রুমধ্য হইতে অপসত হইয়া চন্দ্রকিরণ শেবতপ্রস্তরময় হাম্ম্যতলে পতিত হইয়াছে এবং সমীপস্থ ○ > ○