পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৩২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবক্ষ জিতেন্দ্ৰিয় মাতৃত্যুঞ্জয়ের সমাধিভঙ্গে ক্ষমতাশালিনী বলিয়া কীৰ্ত্তিত করিয়াছেন, সেই শক্তির প্রভাবে হীরার বন্ধি লোপ হইল। দেবেন্দ্র সে সকল কথা ত্যাগ করিয়া, তানপীরা লইলেন এবং সারাপানসমৎসাহিত হইয়া, গীতারম্ভ করিলেন। তখন দৈবকািঠ কৃতবিদ্য দেবেন্দ্র এরপে সন্ধাময় সঙ্গীতলহরী সািজন করিলেন যে, হীরা শ্রীতিমাত্রাত্মক হইয়া একেবারে বিমোহিতা হইল। তখন তাহার হৃদয় চঞ্চল, মন দেবেন্দ্রপ্রেমবিদ্রাবিত হইল। তখন তাহার চক্ষে দেবেন্দ্র সব্ব সংসারসন্দির, সৰ্ব্বব্যাথাসার, রমণীর সব্ববােদরণীয় বলিয়া বোধ হইল। হীরার চক্ষে প্ৰেমবিমক্স আশ্রধারা বহিল। দেবেন্দ্র তানপীরা রাখিয়া, সযত্নে আপনি বসনাগ্রভাগে হীরার অশ্রাবারি মােছাইয়া দিলেন। হীরার শরীর পলককণ্টকিত হইল। তখন দেবেন্দ্র, সারাপানোন্দীপত হইয়া, এরপ হাস্যপরিাহাসসংযক্ত সরস সম্ভাষণ আরম্ভ করিলেন, কখনও বা এরােপ প্রণয়ীর অন্যরােপ স্নেহসিক্ত, অসপভটালঙ্কারবচনে আলাপ করিতে লাগিলেন যে, জ্ঞানহীনা, অপরিমাজিজািতবাগ বন্ধি হীরা মনে করিল, এই সবগ-সখ। হীরা ত কখনও এমন কথা শানে নাই। হীরা যদি বিমলচিত্ত হইত, এবং তাহার বন্ধি সৎসংসগপরিমাডিজত হইত, তবে সে মনে করিত, এই নরক। পরে প্রেমের কথা পড়িল- প্ৰেম কাহাকে বলে, দেবেন্দ্র তাহা কিছই কখন হৃদয়ঙগত করেন নাই—বরং হীরা জানিয়াছিল—কিন্তু দেবেন্দ্র তদিবষয়ে প্রাচীন কবিদিগের চবিবতচক্ৰবণে বিলক্ষণ পাট। দেবেন্দ্রের মখে প্রেমের অনিবাচনীয় মহিমাকীত্তন শনিয়া হীরা দেবেন্দ্রকে অমানষিকচিত্তসম্পন্ন মনে করিল—-সন্বয়ং আপাদকবরী প্ৰেমরসাদ্রা হইল। তখন আবার দেবেন্দ্ৰ প্ৰথমবসন্তপ্রেরিত একমাত্র ভ্রমরাঝঙকারবৎ গান গােন স্বরে, সঙ্গীতোদ্যম করিলেন। হীরা দদািমনীয় প্রণয়সাফত্তিপ্রযক্ত সেই সরের সঙ্গে আপনার কামিনীসলভ। কলকন্ঠধবনি মিলাইতে লাগিল। দেবেন্দ্র হীরাকে গায়িতে অনরোধ করিলেন। তখন হীরা প্রেমাদ্রাচিত্তে, সরোরাগরঞ্জিত কমলনেত্র বিস্ফারিত করিয়া, চিত্ৰিতবং ভ্ৰযোেগবিলাসে মাখমন্ডল প্ৰফল্লি করিয়া প্রসফটস্বরে সঙগীতারম্ভ করিল। চিত্তস্ফীত্তিবশতঃ তাহার কন্ঠে উচ্চ সবের উঠিল। হীরা যাহা গাহিল, তাহা প্রেমবাক্য —প্রেমভিক্ষায় পরিপািণ । তখন সেই পাপমন্ডপে বসিয়া পাপান্তঃকরণ দাই জনে, পাপাভিলাষবশীভুত হইয়া চিরপাপরােপ চিরপ্রেম পরস্পরের নিকট প্রতিশ্রত হইল। হীরা চিত্ত সংযম করিতে জানিত, কিন্তু তাহাতে তাহার প্রবত্তি ছিল না বলিয়া, সহজে পতঙ্গবৎ বহিল্মখে প্রবেশ করিল। দেবেন্দ্রকে অপ্রণয়ী জানিয়া চিত্তসংযমে প্রবত্তি হইয়াছিল, তাহাও অলপদারমাত্র ; কিন্তু যত দর অভিলাষ করিয়াছিল, তত দীর কৃতকাৰ্য্য হইয়াছিল। দেবেন্দ্রকে অণ্ডকাগত প্ৰাপত হইয়া, হাসিতে হাসিতে তাহার কাছে প্রেম স্বীকার করিয়াও, অবলীলাৱক্ৰমে তাহাকে বিমাখ করিয়াছিল। আবার সেই পক্ষপগত কীটানরাপ হৃদয়বোধকারী অন্যরাগকে কেবল পরগনুহে কায্য উপলক্ষ করিয়া শামিত করিয়াছিল। কিন্তু যখন তাহার বিবেচনা হইল যে, দেবেন্দ্র প্রণয়শালী, তখন আর তাহার চিত্তদমনে প্রবত্তি রহিল না। এই অপ্রবত্তি হেতু বিষবক্ষে তাহার ভোগ্য ফল ফলিল। লোকে বলে, ইহলোকে পাপের দন্ড দেখা যায় না। ইহা সত্য হউক বা না হউক।--তুমি দেখিবে না যে, চিত্তসংযমে অপ্রবত্ত অব্যক্তি ইহলোকে বিষবক্ষের ফলভোগ করিল না। সপতত্রিংশতত্তম পরিচ্ছেদ ঃ সােয্যমখীর সংবাদ বিষা গেল। শরৎকাল আসিল । শরৎকােলও যায়। মাঠের জল শকাইল। ধান সকল ফলিয়া উঠিতেছে। পঙ্করিণীর পদ্ম ফরাইয়া আসিল। প্রাতঃকালে বােক্ষপল্লব হইতে শিশির ঝরতে থাকে। সন্ধ্যাকালে মাঠে মাঠে ধামাকার হয়। এমত কালে কাত্তিক মাসের এক দিন প্রাতঃকালে মধ্যপরের রাস্তার উপরে একখানি পালকী আসিল। পল্লীগ্রামে পালকী দেখিয়া দেশের ছেলে খেলা ফেলে পালকীর ধারে কাতার দিয়া দাঁড়াইল । গ্রামের ঝি বউ ম্যাগী ছাগী জলের কলসী কাঁকে নিয়া একটি তফাৎ দাঁড়াইল—কাঁকের কলসী কাঁকেই রহিল-অবাক হইয়া পালকী দেখিতে লাগিল। বউগলি ঘোমটার ভিতর হইতে চোখ বাহির করিয়া দেখিতে লাগিল —আর আর সত্ৰীলোকেরা ফেলা ফেলা করিয়া চাহিয়া রহিল। চাষারা কাত্তিক মাসে ধান কাটিতেছিল—ধান ফেলিয়া, হাতে কাসেত, মাথায় পাগড়ী, হাঁ করিয়া পালকী দেখিতে লাগিল । VO NR NS NR NS