পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৪২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চন্দ্রশেখর তিন জনেই পীড়িতা; তিন জনেই ভয়ে কাতরা; ভয়ের স্বধৰ্ম্মম ভয়ানক বস্তুর দশন পািনঃ পানঃ কামনা করে। শৈবলিনীও আদ্যোপ্রান্ত দেখিল। সকলে চলিয়া গেলে, গহমধ্যে আপনাকে একাকিনী দেখিয়া শায্যোপরি বসিয়া শৈবলিনী চিন্তা করিতে লাগিল। ভাবিল, “এখন কি করি ? একা, তাহাতে আমার ভয় কি ? পথিবীতে আমার ভয় নাই। মাতুর অপেক্ষা বিপদ নাই। যে স্বয়ং অহরহ মহত্যুর কামনা করে, তাহার কিসের ভয় ? কেন আমার সেই মাতুত্যু হয় না ? আত্মহত্যা বড় সহজ-সহজই বা কিসে? এত দিন জলে বাস করিলাম, কই এক দিনও ত ডুবিয়া মরিতে পারিলাম না। রাত্রে যখন সকলে ঘামাইত, ধীরে ধীরে নৌকার বাহিরে আসিয়া, জলে ঝাঁপ দিলে কে ধরিত ? ধরিত-নৌকায় পাহারা থাকিত। কিন্তু আমিও তা কোন উদ্যোগ করি নাই। মরিতে বাসনা, কিন্তু মারিবার কোন উদ্যোগ করি নাই। --তখনও আমার আশা ছিল—আশা থাকিতে মানষে মরিতে পারে না। কিন্তু আজ ? আজি মরিবার দিন বটে। তবে প্রতাপকে বধিয়া লইয়া গিয়াছে—প্ৰতাপের কি হয়, তাহা না জানিয়া মারিতে পারিব না।—প্ৰতাপের কি হয় ? যা হৌক না, আমার কি ? প্ৰতাপ আমার কে ? আমি তাহার চক্ষে পাপিষঠা—সে আমার কে ? কে, তাহা জানি না—সে শৈবলিনী-পতঙ্গের জবলন্ত বহ্নি—সে এই সংসার-প্রান্তরে আমার পক্ষে নিদাঘের প্রথম বিদ্যুৎ—সে আমার মাতৃত্যু। আমি কেন গািহত্যাগ করিলাম, মেলচ্ছের সঙ্গে আসিলাম ? কেন সন্দেরীর সঙ্গে ফিরিলাম না ?” শৈবলিনী আপনার কপালে করাঘাত করিষা অশ্রদ্বষণ করিতে লাগিল। বেদগ্রামের সেই গহ মনে পড়িল।—যেখানে প্রাচীরপাশেব, শৈবলিনী সর্বহস্তে করবীর বক্ষ রোপণ করিয়াছিল —সেই করবীর সর্বোচ্চ শাখা প্রাচীর অতিক্ৰম করিয়া রক্তপক্ষপ ধারণ করিয়া, নীলাকাশকে আকাঙক্ষা করিয়া দলিত, কখন তাহাতে ভ্রমর বা ক্ষদ্র পক্ষী আসিয়া বাসিত, তাহা মনে পড়িল। তুলসী-মণ8—তাহার চারি পাশে বর্ণ পরিস্কৃত, সমাজিজািত ভূমি, গহপালিত মাজার, পিঞ্জরে সফটবাক পক্ষী, গহপাশে বর্ণ সদস্যবাদ, আমের উচ্চ বক্ষ—সকল সমরণাপটে চিত্রিত হইতে লাগিল। কত কি মনে পড়িল! কত সন্দর, সনীল, মেঘশ্যান্য আকাশ, শৈবলিনী ছাদে বসিয়া দেখিতেন; কত সগন্ধ প্রস্ফটিত ধবল। কুসম, পরিস্কার জলসিক্ত করিয়া, চন্দ্ৰশেখরের পাজার জন্য পল্পপাত্র ভরিয়া রাখিয়া দিতেন ; কত স্নিগধ, মন্দ, সগন্ধি বায়, ভীমাতটে সেবন করিতেন; জলে কত ক্ষদ্র তরঙ্গে সাফাটিক বিক্ষেপ দেখিতেন, তাহার তীরে কত কোকিল ডাকিত । হইলেই প্ৰতাপকে দেখিব; মনে করিয়াছিলাম, আবার পােরন্দরপরের কুঠিতে ফিরিয়া যাইবপ্রতাপের গহ এবং পােরন্দরপর নিকট; কুঠির বাতায়নে বসিয়া কটাক্ষ-জাল পাতিয়া প্রতাপপক্ষীকে ধরিব। সংবিধা বঝিলে সেখান হইতে ফিরিঙ্গীকে ফাঁকি দিয়া পলাইয়া যাইব—গিয়া প্রতাপের পদতলে লটাইয়া পড়িব । আমি পিঞ্জরের পাখী, সংসারের গতি কিছই জানিতাম না। জানিতাম না যে, মনতুষ্যে গড়ে, বিধাতা ভাঙ্গে; জানিতাম না যে, ইংরেজের পিঞ্জর লোহার পিঞ্জীর—আমার সাধ্য কি ভাঙিগ। অনৰ্থক কলঙক কিনিলাম, জাতি হারাইলাম, পরকাল নম্ৰাট করিলাম।” পাপিষ্পাঠা শৈবলিনীর এ কথা মনে পড়িল না যে, পাপের অনৰ্থকতা আর সার্থকতা কি ? বরং অনৰ্থকতাই ভাল। কিন্তু একদিন সে এ কথা বঝিবে ; একদিন প্রায়শ্চিত্তজন্য সে অস্থি পৰ্য্যন্ত সমপণ করিতে প্রস্তুত হইবে। সে আশা না থাকিলে, আমরা এ পাপ চিত্রের অবতারণা করিতাম না। পরে সে ভাবিতে লাগিল, “পরকাল ? সে ত যে দিন প্রতাপকে দেখিয়াছি, সেই দিন গিয়াছে। যিনি অন্তৰ্য্যামী, তিনি সেই দিনেই আমার কপালে নরক লিখিয়াছেন। ইহকালেও আমার নরক হইয়াছে—আমার মনই নরক-নাহিলে এত দঃখ পাইলাম কেন ? নাহিলে দাই চক্ষের বিষ ফিরিওগীর সঙ্গে এত কাল বেড়াইলাম কেন ? শািন্ধ কি তাই, বোধ হয়, যাহা কিছ, আমার ভাল, তাহাতেই অগিন লাগে। বোধ হয়, আমারই জন্য প্রতাপ এই বিপদগ্ৰস্ত হইয়াছে,-আমি কেন মরিলাম না ?” শৈবলিনী আবার কাঁদিতে লাগিল। ক্ষণেক পরে চক্ষ মাছিল। ভ্ৰ কুঞ্চিত করিল; অধর দংশন করিল ; ক্ষণকাল জন্য তাহার প্রফতুল্ল রাজীবাতুল্য মাখ, রন্ট সপোের চক্লের ভীমকান্তি শোভা ধারণ করিল; সে আবার বলিল, “মরিলাম না কেন ?” শৈবলিনী সহসা কটি হইতে একটি “গোঁজে” বাহির করিল। তন্মধ্যে তীক্ষাধার ক্ষদ্র ছরিকা ছিল। শৈবলিনী ছরিকা গ্রহণ করিল। তাহার ফলক নিচেস্কাষিত করিয়া, অঙ্গন্ঠের দ্বারা তৎসহিত ক্ৰীড়া করিতে লাগিল। 8 SRCA