পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৪৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Casses কুলসম বলিল, “আমিও, আপনিও । তাই আপনার কাছে আসিয়াছি। পথে শানিলাম, লোকে রটাইতেছে, দলনী বেগম আত্মহত্যা করিয়াছে। সত্য কি ?” নবাব। আত্মহত্যা! রাজদান্ডে সে মরিয়াছে। তুই তাহার দম্প্রকমের সহায়--তুই কুক্করের দ্বারা ভুক্ত হইবি— কুলসম আছড়াইয়া পড়িয়া আত্তনাদ করিয়া উঠিল— এবং যাহা মাখে আসিল, তাহা বলিয়া নবাবকে গালি দিতে আরম্ভ করিল। শনিয়া চারি দিক হইতে সৈনিক, ওমরাহ, ভূত্য, রক্ষক প্রভৃতি আসিয়া পড়িল—একজন কুলসমের চুল ধরিয়া তুলিতে গেল। নবাব নিষেধ করিলেন—তিনি বিস্মিত হইয়াছিলেন। সে সরিয়া গেল। তখন কুলসম বলিতে লাগিল, “আপনারা সকলে আসিয়াছেন, ভালই হইয়াছে। আমি এক অপব্ব কাহিনী বলিব, শােনন। আমার এক্ষণই বধাজ্ঞা হইবে—আমি মরিলে আর কেহ তাহা শনিতে পাইবে না। এই সময় শােনন ।” “শােনন, সবে বাঙ্গালা বেহারের, মীরকাসেম নামে, এক মািখ নবাব আছে । দলনী নামে তাহার বেগম ছিল। সে নবাবের সেনাপতি গরগণ খাঁর ভগিনী।” শনিয়া কেহ আর কুলসমের উপর আক্ৰমণ করিল না। সকলেই পরস্পরের মাখের দিকে চাহিতে লাগিল—সকলেরই কৌত হল বাড়িতে লাগিল। নবাবও কিছ: বলিলেন না—কুলসম বলিতে লাগিল, “গরগণ খাঁ ও দৌলত উন্নেছা। ইসপাহান হইতে পরামর্শ করিয়া জীবিকান্বেষণে বাঙগালায় আসে। দলনী যখন মীরকাসেমের গহে বাঁদীস্বরপ প্রবেশ করে, তখন উভয়ে উভয়ের উপকারার্থ প্ৰতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।” কুলসম, তাহার পরে, যে রাত্রে তাহারা দই জনে গরগণ খাঁর ভবনে গমন করে, তদ্বত্তান্ত সবিস্তারে বলিল। গরগণ খাঁর সঙ্গে যে সকল কথাবাৰ্ত্তা হয়, তাহা দলনীর মাখে শনিয়াছিল, তাহাও বলিল। তৎপরে, প্রত্যাবত্তন আর নিষেধ, ব্রহ্মচারীর সাহায্য, প্রতাপের গহে অবস্থিতি, ইংরেজগণকৃত আক্ৰমণ এবং শৈবালনীভ্রমে দলনীরে হরণ, নৌকায় কারাবাস, আমিয়ট প্রভৃতির মতু্য, ফক্টরের সহিত তাহাদিগের পলায়ন, শেষে দলনীকে গঙ্গাতীরে ফন্টরকৃত পরিত্যাগ, এ সকল বলিয়া শেষে বলিতে লাগিল, “আমার সঙ্কন্ধে সেই সময় সয়ন্তান চাপিয়াছিল সন্দেহ নাই, নহিলে আমি সে সময়ে বেগমকে কেন পরিত্যাগ করিব ? আমি সেই পাপিষ্ঠ ফিরিঙ্গীর দঃখ দেখিয়া তাহার প্রতি——মনে করিয়াছিলাম।--সে কথা যাউক । মনে করিয়াছিলাম, নিজামতের নৌকা পশ্চাৎ আসিতেছে—বেগমকে তুলিয়া লইবে—নহিলে আমি তাঁহাকে ছাড়িব কেন ? কিন্তু তাহার যোগ্য শাসিত আমি পাইয়াছি—বেগমকে পশ্চাৎ করিয়াই আমি কাতর হইয়া ফাস্টরকে সাধিয়াছি যে, আমাকেও নামাইয়া দাও-সে নামাইয়া দেয় নাই। কলিকাতায় গিয়া যাহাকে দেখিয়াছি—তাহাকেই সাধিয়াছি যে, আমাকে পাঠাইয়া দাও-কেহ কিছ বলে না। শনিলাম, হেস্টিং সাহেব বড় দয়াল—তাঁহার কাছে কাঁদিয়া গিয়া তাঁহার পায়ে ধরিলাম—তাঁহারই কৃপায় আসিয়াছি। এখন তোমরা আমার বন্ধেব উদ্যোগ কর—আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা নাই।” এই বলিয়া কুলসমৰ কাঁদিতে লাগিল। বহমতুল্য সিংহাসনে, শত শত রশিম-প্রতিঘাতী রত্নরাজির উপরে বসিয়া, বাঙ্গালার নবাব,- অধোবদনে। এই বহৎ সাম্রাজ্যের রাজদণ্ডড তাঁহার হস্ত হইতে ত সংখলিত হইয়া পড়িতেছে— বহ যত্নেও ত রহিল না। কিন্তু যে অজেয় রাজ্য, বিনা যত্নে থাকিত—সে কোথায় গেল। তিনি কুসম ত্যাগ করিয়া কণাটকে যত্ন করিয়াছেন—কুলসম সত্যই বলিয়াছে—বাঙ্গালার নবাব মািখ ! নবাব ওমরাহ দিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “তোমরা শন, এ রাজ্য আমার রক্ষণীয় নহে। এই বাঁদী যাহা বলিল, তাহা সত্য—বাঙ্গালার নবাব মােখ। তোমরা পাের, সবা রক্ষা কর, আমি চলিলাম। আমি রহিদাসের গড়ে সত্ৰীলোকদিগের মধ্যে ল্যুকাইয়া থাকিব, অথবা ফকিরি গ্রহণ করিব।”—বলিতে বলিতে নবাবের বলিআঠ শরীর, প্রবাহমধ্যে রোপিত বংশখন্ডের ন্যায় কাঁপিতেছিল—চক্ষের জল সক্ষবরণ করিয়া মীরকাসেম বলিতে লাগিলেন, “শন বন্ধবেগা ! যদি আমাকে সেরাজউদ্দৌলার ন্যায়, ইংরেজ বা তাহদের অনচর মারিয়া ফেলে, তবে তোমাদের কাছে আমার এই ভিক্ষা, সেই দলনীর কবরের কাছে আমার কবর দিও। আর আমি কথা কহিতে পারি না—এখন যাও। কিন্তু তোমরা আমার এক আজ্ঞা পালন করা—আমি সেই তাঁকে খাঁকে একবার দেখিব—” 8Wり○