পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৭৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুৰ্থ খণড প্রথম পরিচ্ছেদ সেই রজনীতে হরিধবনিতে সে প্রদেশভূমি পরিপর্ণা হইল। সন্তানেরা দলে দলে যেখানে সেখানে উচ্চৈঃস্বরে কেহ “বন্দে মাতরম" কেহ “জগদীশ হরে” বলিয়া গাইয়া বেড়াইতে লাগিল। কেহ শত্র সেনার অস্ত্র, কেহ বস্ত্র অপহরণ করতে লাগিল। কেহ মন্তদেহের মখে পদাঘাত, কেহ অন্য প্রকার উপদ্রব করিতে লাগিল। কেহ গ্রামাভিমখে, কেহ নগরাভিমাখে ধাবমান হইয়া, পথিক বা গহস্থকে ধরিয়া বলে, “বল বন্দে মাতরম, নহিলে মারিয়া ফেলিব।" কেহ ময়রার দোকান লাঠিয়া খায়, কেহ গোয়ালার বাড়ী গিয়া হাঁড়ি পাড়িয়া দধিতে চুমকি মারে, কেহ বলে, “আমরা ব্ৰজগোপ আসিয়াছি, গোপিনী কই ?” সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, “মাসলমান পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দরে হইয়াছে। সকলে একবার মন্তকণ্ঠে হারি হবি বলা।” গ্রাম্য লোকেরা মসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগমন দিয়া সৰ্ব্বস্ব লাঠিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মসলমান দাঁড়ি ফেলিয়া গায়ে মাত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, “মই হেদা।“ দলে দলে ত্ৰস্ত মসলমানেরা নগরাভিমাখে ধাবিত হইল। চারি দিকে রাজপরিষেরা ছটিল, অবশিস্ট সিপাহী সমসজিত হইয়া নগররক্ষাথে শ্রেণীবদ্ধ হইল। নগরের গড়ের ঘাটে ঘাটে প্রকোম্ঠসকলে রক্ষকবিগ সশস্ত্রে অতি সাবধানে দাবাররক্ষায় নিযক্ত হইল। সমস্ত লোক সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া কি হয় কি হয় চিন্তা করিতে লাগিল। হিন্দরা বলিতে লাগিল, “আসক, সন্ন্যাসীরা আসক, মা দাগ করন, হিন্দরে অদ্যুদ্ষ্টে সেই দিন হউক।” মসলমানেরা বলিতে লাগিল, “আল্লা আকবর ! এত না রোজের পর কোরাণসরিফ, বেবাক কি ঝাঁটা হলো ; মোরা যে পাঁচু ওয়ান্ত নমজ করি, তা এই তেলককাটা হেদির দল ফতে করতে নােরলাম। দনিয়া সব ফাঁকি।” এইরপে কেহ ক্ৰন্দন, কেহ হাস্য করিয়া সকলেই ঘোরতর আগ্রহের সহিত রাত্রি কাটাইতে লাগিল । এ সকল কথা কল্যাণীর কাণে গোল—আবালবদ্ধবনিতা কাহারও অবিদিত ছিল না। কল্যাণী মনে মনে বলিল, “জয় জগদীশবর! আজি তোমার কায্য সিদ্ধ হইয়াছে। আজ আমি সর্বামিসন্দর্শনে যাত্রা করিব। হে মধ্যসািন্দন! আজ আমার সহায় হও!” গভীর রাত্রে কল্যাণী শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিয়া, একা। খিড়কির দাবার খালিয়া এদিক ওদিক চাহিয়া, কাহাকে কোথাও না দেখিয়া, ধীরে ধীরে নিঃশব্দে গৌরীদেবীর পরেী হইতে রাজপথে নিম্প্রকান্ত হইল। মনে মনে ইস্টদেবতা স্মরণ করিয়া বলিল, “দেখ ঠাকুর, আজ যেন পদচিহ্নে তাঁর সাক্ষাৎ পাই।“ কল্যাণী নগরের ঘাঁটিতে আসিয়া উপস্থিত। পাহারাওয়ালা বলিল, “কে যায় ? কল্যাণী ভীতস্বরে বলিল, “আমি সত্ৰীলোক।” পাহারাওয়ালা বলিল, “যাবার হকুম নাই।” কথা দফাদারের কাণে গেল। দফাদার বলিল, “বাহিরে যাইবার নিষেধ নাই, ভিতরে আসিবার নিষেধ।” শনিয়া পাহারাওয়ালা কল্যাণীকে বলিল, “যাও মায়ি, যাবার মানা নেই, লেকেন আজকা রাতমে বড় আফত, কেয়া জানে মায়ি তোমায় কি হোবে, তুমি কি ডেকেতের হাতে গিরালে কি খানায় পড়িয়া মরিয়ে যাবে, সো তো হাম কিছ জানে না, আজকা রাত মায়ি, তুমি বাহার না। যাবে। ” কল্যাণী বলিল, “বাবা, আমি ভিখারিণী—আমার এক কড়া কপদকও নাই, আমায় ডাকাতে কিছ বলিবে না।” পাহারাওয়ালা বলিল, “বয়স আছে, মায়ি বন্যাস আছে, দনিয়ামে ওহি তো জেওরাত হ্যায়! বলকে হামি ডেকেত হতে পারে।” কল্যাণী দেখিল বড় বিপদ, কিছ. কথা না কহিয়া, ধীরে ধীরে ঘাঁটি এড়াইয়া চলিয়া গেল। পাহারাওয়ালা দেখিল, মায়ি রসিকতাটা বঝিল না, তখন মনের দঃখে গাঁজায় দম মারিয়া ঝিঝিট খামবাজে সোরির টপ ধাঁরল। কল্যাণী চলিয়া গেল। 6 CA WVy