পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় তৃতীয় খণ্ড.djvu/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তৃতীয় সংখ্যা । ] নৌকাডুৰি । >૨૧ চায়ের আয়োজন প্রস্তুত হইলে হেমনলিনী একটু যেন দ্বিধার ভাবে রমেশকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনাকে চা দিব কি ?” রমেশ এই অকারণ প্রশ্নের অর্থ বুঝিতে পরিল। তখন যে ধারা চলিয়া আসিতেছিল, তাহা যদি সমস্ত বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকে, তবে আর কি চা দিতে হইবে ? সবই যদি গিয়া থাকে, তবে এটুকু কি আর আছে ? রমেশ কহিল, “চা দিবেন বৈ কি ?” হেমনলিনী কহিল, “এ অভ্যাস বুঝি আপনার যায় নাই ?” বড় বড় ব্যাপার বিপৰ্য্যস্ত হইয়া যায়, কিন্তু এটুকু থাকে ! বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন হয়, কিন্তু চায়ের নেশা বরাবর টিকে ; চোখে চোথে যে ছিল, সে চিরদিনের মত অস্তরালে পড়িয়া যায়, কিন্তু ধুমপানের হু কাটি কোনদিন কাছছাড়া হয় না—মানবজীবনের মধ্যে এই যে একটি বেদনাময় কৌতুক আছে, হেমনলিনীর ঐ তুচ্ছ প্রশ্নের মধ্যে গৃঢ়ভাবে হয় ত তাহারই প্রতি লক্ষ্য ছিল । রমেশ কিছু না বলিয়া চা খাইতে লাগিল । অন্নদাবাবু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন,- “এবার ত তুমি অনেকদিন বাড়ীতে ছিলে, কাজ ছিল বুঝি ?” রমেশ কহিল, “বাবার মৃত্যু হইয়াছে—” অন্নদীবাবু। অ্যা, বল কি ! সে কি কথা ! কেমন করিয়া হইল ? রমেশ । তিনি পদ্মা বাহিয়া নৌকা করিয়া বাড়ী আসিতেছিলেন, হঠাৎ ঝড়ে নৌকা ডুবিয়া তাহার মৃত্যু হয় । একটা প্রবল হাওয়া উঠিলে যেমন অকস্মাৎ ঘন মেঘ কাটিয়া আকাশ পরিষ্কার হইয়া যায়, তেমনি এই শোকের সংবাদে রমেশ । ও হেমনলিনীর মাঝখানকার মানি মুহূর্বের মধ্যে কাটিয়া গেল। হেমনলিনী এতক্ষণ যে ঔদাসীন্ত দেখাইবার চেষ্টা করিতেছিল, তাহ। আর টিকিল না, তৎক্ষণাৎ তাহার মুখে করুণ জাগিয়া উঠিল । সে অকুতাপসহকারে মনে মনে কহিল, “রমেশবাবুকে ভুল বুঝিয়াছিলাম,—তিনি পিতৃবিয়োগের শোকে এবং গোলমালে উদভ্ৰান্ত হইয়াছিলেন । ” এখনো হয় ত তাহাই লইয়া উন্মন হইয় আছেন। উ হার সাংসারিক কি সঙ্কট ঘটিয়াছে, উ হার মনের মধ্যে কি ভার চাপিয়াছে, তাহা কিছুই না জানিয়াই আমরা, উহাকে দোষী করিতেছিলাম।” _ হেমনলিনী এই পিতৃহীনকে বেশি করিয়া যত্ন করিতে লাগিল। রমেশের আহারে অভিরুচি ছিল না, হেমনলিনী তাহাকে বিশেষ পীড়াপীড়ি করিয়া খাওয়াইল । কহিল, “আপনি বড় রোগ হইয়া গেছেন, শরীরে অযত্ন করিবেন ন৷ ” অন্নদীবাবুকে কহিল—“বাবা, রমেশবাবু আজ রাত্রেও এইথানেই খাইয়া যান না।” অন্নদীবাবু কহিলেন, “বেশ ত ।” এমন-সময় অক্ষয় আসিয়া উপুস্থিত। অন্নদাবাবুর চায়ের টেবিলে কিছুকাল অক্ষয় একাধিপত্য করিয়া আসিয়াছে । পুৰ্ব্বকথিত ব্যারিষ্টারটি যখন এ পরিবারের আকর্ষণ হইতে স্খলিত হইয়া গেল এবং হঠাৎ দীর্ঘকাল ধরিয়া যখন রমেশের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল ন, তখন হইতে অক্ষয় অন্নদীবাবুর চায়ের