পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় তৃতীয় খণ্ড.djvu/১৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুর্থ সংখ্যা । ] আঙুল কখন কোথায় গিয়া পড়ে, তাহার ঠিকানা নাই,—পদে পদে ভুল স্বর বাজে, কিন্তু রমেশের কানে তাহ বাজে না, সুরবেসুরের মধ্যে সে কোনপ্রকার পক্ষপাত না করিয়া দিব্য নিশ্চিন্তমনে রাগরাগিণীকে সৰ্ব্বত্র লঙ্ঘন করিয়া যার । হেমনলিনী যেই বলে, *ও কি করিতেছেন, ভুল হইল যে,”—আমনি অত্যন্ত তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় ভুলের দ্বারা প্রথম ভুলটা নিরাকৃত করিয়া দেয় । গম্ভীরপ্রকৃতি অধ্যবসায়ী রমেশ হাল ছাড়িয়া দিবার লোক নহে। রাস্তাতৈরির ষ্টীম্রোলার যেমন মন্থরগমনে চলিতে থাকে, তাহার তলায় কি যে দলিতপিষ্ট হইতেছে, তাহার প্রতি ক্ৰক্ষেপমাত্র করে না, হতভাগ্য স্বরলিপি এবং হাৰ্ম্মোনিয়মের চাবিগুলার উপর দিয়া রমেশ সেইরূপ অনিবাৰ্য্য অন্ধতার সহিত বারবার যাওয়া-আসা করিতে লাগিল । রমেশের এই মুঢ়তায় হেমনলিনী হাসে, রমেশও হাসে। রমেশের ভুল করিবার অসাধারণ শক্তিতে হেমনলিনীর অত্যন্ত আমোদ বোধ হয় । ভুল হইতে, বেস্থর হইতে, অক্ষমতা হইতে আনন্দ পাইবার শক্তি ভালবাসারই আছে । শিশু চলিতে আরম্ভ করিয়া বারবার ভুল পা ফেলিতে থাকে, তাহাতেই মাতার স্নেহ উদ্বেলিত হইয়া উঠে । বাজনাসম্বন্ধে রমেশ যে অদ্ভুতরকমের অনভিজ্ঞতা প্রকাশ করে, হেমনলিনীর এই এক বড় কৌতুক । রমেশ একএকৰার বলে, “আচ্ছ, আপনি যে এত হাসিতেছেন, আপনি যখন প্রথম বাজাইতে শিখিতেছিলেন, তখন ভুল করেন নাই ?” নৌকাডুবি । XSe> হেমনলিনী বলে—“ভুল নিশ্চয়ই করিতাম, কিন্তু সত্য বলিতেছি রমেশবাবু, আপনার সঙ্গে তুলনাই হয় না।” রমেশ ইহাতে দমিত না, হাসিয়া আবার গোড়া হইতে স্বরু করিত। অন্নদাবাৰু সঙ্গীতের ভালমন্দ কিছুই বুঝিতেন না, তিনি এক একবার গম্ভীর হইয়া কান খাড়। করিয়া দাড়াইয়া কহিতেন—“তাই ত, রমেশের ক্রমেই হাত বেশ পাকিয়া আসিতেছে।” হেমনলিনী বলিত, “হাত বেজুরায় পাকিতেছে।” - অন্নদা । না না, প্রথমে যেমন শুনিয়াছিলাম, এখন তার চেয়ে অনেকটা অভ্যাস হইয়া আসিয়াছে। আমার ত বোধ হয়, রমেশ যদি লাগিয়া থাকে, তাহা হইলে উহার হাত নিতান্ত মন্দ হইবে না । গানবাজনায় আর কিছু নয়, খুব অভ্যাস করা চাই। একবার সারেগামার বোধটা জন্মিয় গেলেই . তাহার পরে সমস্ত সহজ হইয়া অাসে । এ সকল কথার উপরে প্রতিবাদ চলে সকলকে নিরুত্তর হইয়া শুনিতে হয় । >* _o প্রীয় প্রতিবৎসর শরৎকালে পূজার টিকিট বাহির হইলে হেমনলিনীকে লইয়া অন্নদাবাবু জব্বলপুরে তাহার ভগিনীপতির কৰ্ম্মস্থানে বেড়াইতে যাইতেন । পরিপাকশক্তির উন্নতিসাধনের জন্ত র্তাহার এই সাংবৎসরিক চেষ্টা । ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি হইয়া আসিল, এবারে পুজার ছুটির আর বড় বেশি বিলম্ব? নাই। অন্নদাবাবু এখন হইতেই তাহার যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত হইয়াছেন । না ।