পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় তৃতীয় খণ্ড.djvu/৪৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দশম সংখ্যা । ] নৌকাডুবি । 8ఆలి নিস্তরঙ্গ জলের উপর দিয়া অাপন কালিমা বহিয়া নিঃশব্দে গুণ টানিয়া চলিয়াছিল। রমেশ জাহাজের ছাদের সম্মুখভাগে নবোদিত শুক্লপক্ষের তরুণর্চাদের আলোকে বেতের কেদার টানিয়া-লইয়া বসিয়া ছিল। এই শূন্ত নদীতটের সন্ধ্যার উদ্ধদেশে চাদ যেমন দিকৃপ্রাস্তের কুহেলিকা হইতে নিৰ্ম্মল মধ্যাকাশে আপনি ভাসিয়া উঠিতেছে—তেমনি রমেশের সমস্ত চিত্তের গভীরতা হইতে একটি মধুর স্মৃতি বিকীর্ণ মেঘজালের ভিতর দিয়া আপনি নিঃশব্দপদে সকলের উচ্চে ভাসিয়া উঠিতেছিল । কালিদাস বলিয়াছেন–রমণীয় দৃপ্ত দেখিলে এবং মধুর ধ্বনি শুনিলে জন্মাস্তরের ভালবাসাগুলি যেন মনে পড়িয়া যায় । কালিদাসের সেই শ্লোকটি মনে মনে আরক্তি করিয় রমেশ ভাবিতে লাগিল, ইহজন্মের মধ্যেই জন্মান্তর ঘটে । বেশিদিনের কথা নয়, —একমাস ও হইবে না—সেদিন ত আজ একেবারে গতজন্মের মতই গত । সেই দিনের মধ্যে আজি প্রবেশের কোন পথই দেখা যাহতেছে না—হঠাৎ মাঝখানে যেন একমুহূর্তে বহুশতাব্দ প্রবাহিত হইয়া সেদিনকে অতিদুর •পরপারের অস্তাচলচ্ছায়ার মধ্যে লইয়া গেছে।’ আজিকার এই নদীতীরের শরৎসন্ধ্য। তাহার জগদ্ব্যাপা বৃহৎ অবসানবেদনার নিস্তব্ধতায় রমেশের সেই গতজন্মকে আচ্ছন্ন করিয়া ঐ স্তৰূকুলায় আম্রবনে, ঐ তৃণশূন্ত বালুতটে, এই তরঙ্গরেখাবিহীন বিপুল জলরাশির • উপরে একাকিনা অব গুঠি গুমুখে ক্ষণিজ্যোৎস্ন আকাশতলে দাড়াইয়া আছে। তাহার সেদিনের সহিত আজিকার দিনের ক্ষণকালের মধ্যেই এত-বড় বিচ্ছেদ হইয়া গেছে, তবু সেই অতীতলক্ষ্মী বিশ্বজগৎকে সেই চিরপরিচিত মুৰ্ত্তিতে উন্মেষিত করিয়া তুলিতেছে। সেই ভাবগভীর মুখ, সেই নিৰ্ম্মল ললাটের উপরে জলভারনম্র নবমীরদের মত স্তম্ভিত কেশরাজি, সেই সুকুমার গ্রীবা, সেই তরুণ তমুদেহে কোমল শাড়ীটির তরঙ্গিত অঞ্চলরেখা, সেই স্নিগ্ধবিশ্বস্ত দৃষ্টির নিবিড় একাগ্রত আজ সায়াহ্রের মানিমা হইয়া, সন্ধ্যাতারার স্বদুল্লত হইয়া, তরুপ্রচ্ছন্ন গ্রামের নিভূত-নিস্তব্ধ বিশ্রাম হইয়া, জনশূন্ত বালুতটের দিগন্তপ্রসারিত পাণ্ডুরতী হইয়া বিশাল প্রকৃতির মুক-বৃহৎ অব্যক্তভাষায় জলে-স্থলে-আকাশে,— চন্দ্রের অ-ফুট আলোকে ও বনের প্রগাঢ়চ্ছায়ায়,— নদীর স্তিমিত-গোপন গতিতে ও তটভূমির তিমিরাচ্ছন্ন গম্ভীর নিশ্চলতায় অপরূপভাবে ভাষান্তরিত হইতে লাগিল এবং রমেশকে অস্তরে-বাহিরে, আপাদমস্তকে, তাহার চেতনার কুহরে-কুহরে আবিষ্ট করিয়া ধরিল—অনিৰ্ব্বচনীয় বেদনায় তাহার হৃৎপিণ্ডকে পীড়ন করিয়া তাহার বিদীর্ণ শতচ্ছিদ্র হইতে প্রেমের স্বধারসধারা তীক্ষুবেগে লিস্তব্ধ নক্ষত্ৰলোকের মাঝখানে উৎসারিত করিয়া দিল । পশ্চিম অণকণশ হইতে সন্ধ্যার শেষ . স্বর্ণচ্ছায়া মিলাইয়া গেল ; চন্দ্রীলোকের ইন্দ্র জালে কঠিন জগং যেন গানে, যেন স্বপ্নে, যেন কবির কল্পনারূপে বিগলিত হইয়া আসিল । রমেশ মাপনা-আপনি মৃদুস্বরে বলিতে লাগিল—“হেম, হেম !”—সেই নামের শব্দটিমাত্র যেন সুমধুর-স্পর্শরূপে তাহার