পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় তৃতীয় খণ্ড.djvu/৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সকালুবেলায় জেলেডিঙির শাদী-শাদী পালে নদী খচিত হইয়া উঠিল। রমেশ তাহারই একটিকে ডাকাডাকি করিয়া লইয়া জেলেদের সাহায্যে একখানি বড় পান্সি ভাড়া করিল এবং নিরুদ্দেশ আত্মীয়দের সন্ধানের, জন্ত পুলিস নিযুক্ত করিয়া বধূকে লইয়া গৃহে রওনা হইল । গ্রামের ঘাটের কাছে নৌকা পৌছিতেই রমেশ খবর পাইল যে, তাহার পিতার, শাশুড়ির ও আর কয়েকটি আত্মীয় বন্ধুর মৃতদেহ নদী হইতে পুলিস উদ্ধার করিয়াছে। জনকয়েক মাল্লা ছাড়া আর যে কেহ বাচিয়াছে, এমন অাশা আর কাহারো রহিল না । -বাড়ীষ্ঠে রমেশের বৃদ্ধ ঠাকুরমা ছিলেন, তিনি বধুসহ রমেশকে ফিরিতে দেখিয়া উচ্চকলরবে কাদিতে লাগিলেন । পাড়ার যে সকল বরযাত্র গিয়াছিল, তাহাদেরও ঘরে ঘরে কান্না পড়িয়া গেল- এইরূপ প্রবল শোকের ঝড়তুফানের মধ্যে বধুটি যেন একখানি নুতনতৈরি ছোট নৌকার মত ভয়ে, ছঃখে, সঙ্কোচে আপনার প্রথম অপরিচিত সংসারযাত্র আরম্ভ করিল। শাখ বাজিল না, হুলুধ্বনি হইল না, কেহ তাহাকে বরণ করিয়া লইল না.. কেহ তাহার দিকে তাকাইল না মাত্র । রমেশ মৃত আত্মীয়দের সৎকার করিয়া ঘরে ফিরিয়া আসিল । দেখুিল, তাহীদের বাড়ীতে যে দুইচারিজন প্রাচীন আত্মীয়া অবশিষ্ট ছিলেন, তাহারা বধূকে সকল অকল্যাণের কারণ স্থির করিয়া তাহার প্রতি একেবারে বিমুখ হইয়াছেন । তাহীদের তারস্বরে বিলাপোক্তির মধ্যে দুলক্ষণ বধুর প্রতি আক্রোশ যথেষ্ট ছিল । ইহাতে আত্মীয়শোকের মধ্যেও রমেশ তাহার এই হতভাগিনী স্ত্রীর জন্ত বিশেষ করিয়া বেদনা বোধ-করিল। এই স্বজনপরিত্যক্ত বালিকাটির সামান্ত মুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিও কাহারে দৃষ্টি ছিল না । সে যে কি খাইবে, কোথায় দাড়াইবে, কোথায় বসিবে, বধু তাহাও জানে না । মৃত্যুমুখ হইতে সে যে মরুতীরে উঠিয়াছিল, এ গ্রহ তাহা অপেক্ষ দ্বিগুণ মরুময় । চিরকালের জন্ত এই গৃহকেই তাহার গৃহরূপে বরণ করিয়া লইতে হইবে, এ কথা মনে করিয়া তাহার হৃৎকম্প হইতে লাগিল ।