পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় তৃতীয় খণ্ড.djvu/৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয় সংখ্যা । ] নৌকাডুবি । やう。 অল্পে সাহিত্যরসের নেশা ধরাইয়া দিবে, এরূপ উপক্রম করিতেছে, এমন-সময় দুগ্রহ হঠাৎ আর একবার জাগিয়া উঠিল । একদিন সন্ধ্যাবেলায় রমেশ বালিকার খোপ। ধরিয়া নাড়া দিয়া কহিল, “সুশীলা, আজ তোমার চুলবাধা ভাল হয় নাই ।” বালিকা বলিয়া বসিল, “আচ্ছ, তোমরা সকলেই আমাকে সুশীল৷ বলিয়া ডাক কেন ?” রমেশ এ প্রশ্নের তাৎপৰ্য্য কিছুই বুঝিতে না পারিয়। অবাক হইয় তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল । . বধু কহিল, “আমার নাম বদল হইলেই কি আমার পয় ফিরিবে ? আমি ত শিশুকাল হইতেই অপয়মস্ত—ন মরিলে আমার আলক্ষণ ঘুচিবে ন৷ ” হঠাৎ রমেশের বুক ধকৃ করিয়া উঠিল, তাহার মুখ পা ধুবৰ্ণ হইয় গেল--কোথায় কি একটা প্রমাদ ঘটিয়াছে, এ সংশয় হঠাৎ তাহার মনে জাগিয়া উঠিল । রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “শিশুকাল হইতেই তুমি - অপয়মস্ত ক্লিসে হইলে ?” বধু কহিল, “আমার জন্মের পূৰ্ব্বেই আমার বাবা মরিয়াছেন, আমাকে জন্মদান করিয়া তাহার ছয়মাসের মধ্যে আমার মা মারা গেছেন এ. মামার বাড়ীতে অনেক কষ্টে ছিলাম। হঠাৎ শুনিলাম, কোথা হইতে আসিয়া তুমি আমাকে পছন্দ করিলে - দুইদিনের মধ্যেই বিবাহ হইয়া গেল, তার পরে দেখ, কি সব বিপদই ঘটিল ! এই দেখ, আমি তিনমাস এখানে থাকিতে থাকিতে তিনটি পার্থী আমার মরিয়াছে ! আমি জানি, ওর একটাও বাচিবে না ।” রমেশ নিশ্চল হইয়া তাকিয়ার উপরে : শুইয়া পড়িল । আকাশে চাদ উঠিয়াছিল, তাহার জ্যোৎস্ন। কালী হইয়া গেল । রমেশের* দ্বিতীয় প্রশ্ন করিতে ভয় হইতে লাগিল । যতটুকু জানিয়া ফেলিয়াছে, সেটুকুকে সে প্ৰলাপ বলিয়, স্বপ্ন বলিয়া সুদূরে ঠেলিয়। রাখিতে চায়। পাছে নিদারুণ কোন সত্যকে আর চাপিয়া রাখা না যায়, পাছে সুকঠিন সত্য এখনি কুহেলিকামুক্ত-সুবিপুল-পৰ্ব্বতসমান অভ্ৰভেদী হইয়া উঠে, এই ভয়ে রমেশ চুপ করিয়া আড়ষ্ট হইয়া রহিল । সংজ্ঞাপ্রাপ্ত মূৰ্ছিতের দীর্ঘশ্বাসের মত গ্রীষ্মের"দক্ষিণ হাওয়া বহিতে লাগিল। জ্যোৎস্নালোকে নিদ্রাহীন কোকিল ডাকিতেছে—অদূরে নদীর ঘাটে বাধা নৌকার ছাদ হইতে মাঝিদের গান আকাশে জ্যোৎস্নার মধ্যে ব্যাপ্ত হইতেছে । অনেকক্ষণ কোন সাড়া না পাইয়া বধু অতি ধীরে ধীরে রমেশকে স্পর্শ করিয়া কহিল, “ঘুমাইতেছ?” রমেশ কহিল, “না।” তাহার পরে ও অনেকক্ষণ রমেশেব আর কোন সাড়া পাওয়া গেল না। বধু কখন আস্তে আস্তে ঘুমাইয়া পড়িল । রমেশ উঠিয়াবসিয়া তাহার নিদ্রিত মুখের দিকে চাহিয়া রহিল । কি সুন্দর মুখখানি । ফুলের মত অম্লান-কোমল! তরুণ হৃদয়ের মৃদ্ধ সুগন্ধটুকু যেন ঐ সরল স্বকুমার মুখ হইতে মিশ্বসিত হইয়া উঠিতেছে। বিধাতা ইহার ললাটে ষে গুপ্তলিখন লিখিয়া রাখিয়াছেন, তাহ আজো এই মুখে একটি আঁকি কাটে নাই। এমন সৌন্দর্য্যের ভিতরে সেই ভীষণ পরিণাম কেমন করিয়} প্রচ্ছন্ন হইয়া বাস করিতেছে ।