পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় দ্বাদশ খণ্ড.djvu/৬৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ఆ98 স্থবিরত ও বদ্ধভাবের পক্ষপাতী ছিলেন ন, এ কথা দৃঢ়ভাবে বলিতে পারা যায়। কিন্তু তথাপি যে ভাবে আমাদের বর্তমান সমাজ-সংস্কারকেরা জাতিভেদ-প্রথাকে ভাঙ্গিতেছেন বা ভাঙ্গিতে চাহিতেছেন, উপাধ্যায় তাহার সমর্থন করেন নাই। আর করেন নাই এই জন্য যে আমরা এই পথে আমাদের প্রাচীন জাতিভেদপ্রথার উচ্ছেদ সাধন করিয়া, বিদেশের আমদানী আর এক প্রকারের ঘূণ্যতর ও সহস্ৰগুণে অধিক অমঙ্গলকর জাতিভেদের প্রতিষ্ঠা করিতে বসিয়াছি। বিদেশীয় সমাজে ইহাকে জাতিভেদ বলে না বটে। র্তাহারা ইহাকে শ্রেণীভেদ বলেন। কিন্তু যে নামেই নির্দিষ্ট হউক না কেন, বস্তু দুটী এক ন হইলেও যে নিতান্তই স-জাতীয় ইহা কি অস্বীকার করা যায় ? অার এখানে প্রশ্ন এই যে সামাজিক স্থবিরতা-পোষক যে বংশগত জাতিভেদ আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, তাহার যতই দোষ থাকুক না কেন, ইহার বদলে আমরা, সংস্কারের নামে, সমাজের বিপ্লবসাধক, পদগত বা ধনগত যে বিলাতী শ্রেণীভেদকে জ্ঞাতসারেই হউক আর অজ্ঞাতসারেই হউক, আমাদের সমাজে বরণ করিয়া লইতেছি, তাহার দোষ তদপেক্ষ বেশি কি না ? এই বিষয়ে উপাধ্যায় এই প্রশ্নটাই তুলিতেন। আর এই প্রশ্নের সোজা উত্তর কেবল একটা— বিলাতী শ্রেণীভেদের দোষ আমাদের জাতিভেদের দোষ অপেক্ষা আকারে ভিন্ন হইলেও, ওজনে কম নহে। আমাদের বঙ্গদর্শন [ ১২শ বৰ্ষ, মাঘ, ১৩১৯ জাতিভেদ মানুষের মনুধ্যত্ব-বস্তুকে হয় ত কোনও কোনও স্থলে চাপিয়া রাখে, বিলাতী শ্রেণীভেদ তাহাকে পিষিয়া মারে। সুতরাং যেরূপ করিয়াই হউক, এই পুরাগত জাতি ভেদকে ভাঙ্গিয়া দিলেই যে আমাদের সমাজ উন্নতির পথে ও কল্যাণের পথে অগ্রসর হইবে, উপাধ্যায় এমনটা বিশ্বাস করিতেন না। জাতিভেদের সংস্কার সম্বন্ধে যে কথা, অন্তান্ত সমাজসংস্কার সম্বন্ধেও সেই কথা । যেটাকে ভাঙ্গিয়া যেটাকে গড়িতে যাইতেছি, তাহা কি বেশি ভাল ? যেমন প্রচলিত জাতিভেদ, সেক্টরূপ বর্তমানে যে আকারে বাল্যবিবাহ-প্রথা দেশে প্রবর্তিত আছে, তাহাও সমাজের উন্নতি ও কল্যাণের ঠিক সহায় ষে নয়,—এ কথা উপাধ্যায় জানিতেন এবং মানিতেন। এ কুপ্রথা এক সময়ে আমাদের সমাজেও ছিল না। কোন যুগে, কি কারণে, কোন বিশেয অবস্থাধীনে ইহা প্রচলিত হয়, স্থির করা বহুবিস্তৃত-ও সূক্ষ্ম গবেষণা-সাপেক্ষ। কিন্তু যখন এবং যে কারণেই ইহা প্রথমে প্রবৰ্ত্তিত হউক, না কেন, হিন্দুসমাজে যখন প্রাণশক্তি প্রবল ছিল, তখন সমাজ আপশু হইতেই ইহার আনুসঙ্গিক অমঙ্গল ফলগুলি, একান্ত ভাবে না হউক, অন্ততঃ বহুল পরিমাণে নিবারণ করিবার উপায় উদ্ভাবন করিয়া লইয়াছিল। সমাজের সে প্রাণশক্তির হীনতা নিবন্ধন ক্রমে এ সকলও ব্যর্থ বা নষ্ট হইয়া গিয়াছে। সুতরাং আজ বাল্যবিবাহ-প্রথ। যতটা অনিষ্টকর হইয়া উঠিয়াছে, কিছুকাল পূৰ্ব্বেও তত অনিষ্টকর ছিল না। এ সকলই সত্য ।