পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রথম সংখ্যা । ] কাঁশে আরামে আসনগ্রহণ করিয়াছে। .এই নিখিল গৃহিণীর রান্নাঘর কোথায়, টেকিশালা কোথায়, কোন ভাণ্ডারের স্তরে স্তরে” ইহার বিচিত্র আকারের ভাণ্ড সাজানো রহিয়াছে ? ইহার দক্ষিণ হস্তের হাতাবেড়িগুলিকে আভরণ বলিয়া ভ্রম হয়, ইহার কাজকে লীলার মত মনে হয়, ইহার চলাকে নৃত্য এবং চেষ্টাকে ঔদাসীন্তের মত জ্ঞান হয়। ঘূর্ণ্যমান চক্রগুলিকে নিম্নে গোপন করিয়া, স্থিতিকেই গতির উদ্ধে রাখিয়া, প্রকৃতি আপনাকে নিত্যকাল প্রকাশমান রাথিয়াছে — উদ্ধশ্বাস কৰ্ম্মের বেগে নিজেকে অস্পষ্ট এবং সঞ্চায়মান কৰ্ম্মের স্তুপে নিজেকে আচ্ছন্ন করে নাই । এই কৰ্ম্মের চতুর্দিকে অবকাশ, এই চাঞ্চল্যকে ধ্রুবশাস্তির দ্বারা মণ্ডিত করিয়া রাখা,—প্রকৃতির চিরনবীনতার ইহাই রহস্ত । কেবল নবীনত নহে, ইহাই তাহার বল । ভারতবর্ষ তাহার তপ্ততাম্র আকাশের নিকট, তাহার শুষ্কন্ধুসর প্রাস্তরের নিকট, তাহার জলজ্জটামণ্ডিত বিরাঢ় মধ্যান্ত্রের নিকট, डाँशत्र নিৰ্যকুফ নিঃশব্দ রাত্রির নিকট হইতে এই উদার শাস্তি, এই বিশাল স্তব্ধত আপনার অন্তঃকরণের মধ্যে লাভ করিয়াছে। ভারতবর্ষ কৰ্ম্মের ক্রীতদাস নহে। সকল জাতির স্বভাবগত আদর্শ এক নয়— তাহা লইয়া ক্ষোভ করিবার প্রয়োজন দেখি না। ভারতবর্ষ মানুষকে লঙ্ঘন করিয়া কৰ্ম্মকে বড় করিয়া তোলে নাই । ফলাকাজক্ষাহীন কৰ্ম্মকে মাহাত্ম্য দিয়া সে বস্তুত কৰ্ম্মকে সংযত করিয়া লইয়াছে। ফলের নববর্ষ। Ꮼ☾ আকাজু উপূড়াইয়া ফেলিলে কম্মের বিষ দীত ভাঙিয়া ফেলা হয় । এই উপায়ে মানুষ কৰ্ম্মের উপরেও নিজেকে জাগ্রত করিবার অবকাশ পায়। হওয়াই আমাদের দেশের চরম লক্ষ্য, করা উপলক্ষ্যমাত্র। বিদেশের সংঘাতে ভারতবর্ষের এই প্রাচীন স্তব্ধতা ক্ষুব্ধ হইয়াছে। তাহাতে যে আমাদের বলবৃদ্ধি হইতেছে, এ কথা আমি মনে করি না । ইহাতে আমাদের শক্তিক্ষয় হইতেছে। ইহাতে প্রতিদিন আমাদের নিষ্ঠ বিচলিত, আমাদের চরিত্র ভয় বিকীর্ণ, আমাদের চিত্ত বিক্ষিপ্ত এবং আমাদের চেষ্টা ব্যর্থ হইতেছে। পূৰ্ব্বে ভারতবর্ষের কার্য্যপ্রণালী অতি সহজ-সরল, অতি প্রশান্ত, অথচ অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। তাহাতে আড়ম্বর মাত্রেরই অভাব ছিল, তাহাতে শক্তির অনাবশ্যক অপব্যয় ছিল না । সতী স্ত্রী অনায়াসেই স্বামীর চিতায় আরোহণ করিত, সৈনিক-সিপাহী অকাতরেই চান চিবাইয়া লড়াই করিতে যাইত, আচাররক্ষার জন্ত সকল অসুবিধা বহন করা, সমাজরক্ষার জন্ত চূড়ান্ত দুঃখ ভোগ করা এবং ধৰ্ম্মরক্ষার জন্ত প্রণবিসর্জন করা, তখন অত্যন্ত সহজ ছিল। নিস্তব্ধতার এই ভীষণ শক্তি ভারতবর্ষের মধ্যে এখনো সঞ্চিত হইয়া আছে ; আমরা নিজেই ইহাকে জানি না। দারিদ্র্যের বে কঠিন বল, মেীনের যে স্তম্ভিত আবেগ, নিষ্ঠার যে কঠোর শাস্তি এবং বৈরাগ্যের যে উদার গাম্ভীৰ্য্য, তাহ আমরা কয়েকজন শিক্ষাচঞ্চল যুবক বিলাসে, অবিশ্বাসে, অনাচারে, অমুকরণে, এখনো ভারতবর্ষ হতে দূর করিয়া দিতে পারি নাই।