পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় ষষ্ঠ খণ্ড.djvu/৪৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8○8 না—অবশেষে পীড়া দিয়া পীড়া পাইয়া সেটা মরিল। আমাদের প্রবৃত্তি উগ্র হইয়া উঠিলে বিধাতার জগতের বিরুদ্ধে নিজে যেন স্মৃষ্টি করিতে থাকে। তখন চারিদিকের সঙ্গে তাহার আর মিল খায় না। আমাদের ক্রোধ, আমাদের লোভ নিজের চারিদিকে এমন সকল বিকার উৎপাদন করে, যাঙ্গতে ছোটই বড় হইয় উঠে, বড়ই ছোট হইয়া যায়, যাহা ক্ষণকালের, তাহাকেই চিরকালের বলিয়া মনে হয়, যাহা চিরকালের, তাহ চোখেই পড়ে না। যাহার প্রতি আমাদের লোভ জন্মে, তাহাকে আমরা এম্নি অসত্য করিয়া গড়িয়া তুলি যে, জগতের বড় বড় সত্যকে সে আচ্ছন্ন করিয়া দাড়ায়, চন্দ্রস্থ্য তারাকে সে স্নান করিয়া দেয় । ইহাতে আমাদের স্মৃষ্টি বিধাতার সঙ্গে বিরোধ করিতে থাকে। মনে কর নদী চলিতেছে ; তাহার প্রত্যেক ঢেউ' স্বতন্ত্র হইয়া মাথা তুলিলেও তাহার সকলে মিলিয়া সেই এক সমুদ্রের দিকে গান করিতে করিতে চলিতেছে। কেহ কাহাকেও বাধা দিতেছে না । কিন্তু ইহার মধ্যে যদি কোথাও পাক পড়িয়া যায়, তবে সেই ঘূর্ণ এক জায়গাতেই দাড়াইয়া উন্মত্তের মৃত ঘুরিতে থাকে,-চলিবার বাধা দিয়া ডুবাইবার চেষ্টা করে ; সমস্ত নদীর যে গতি, যে অভিপ্রার, তাহাতে ব্যাঘাত জন্মাইয়া সে স্থিরত্বও লাভ করে না, অগ্রসর হইতেও পারে না। আমাদের কোন-একটা প্রবৃত্তি উন্মত্ত হইয়া উঠিলে সেও আমাদিগকে নিখিলের প্রবাহ হইতে টানিয়া লইয়া একটা বিলুর উপরেই ঘুরাইয়া মারিতে থাকে। আমাদের বঙ্গদর্শন । [ છે বর্ষ, পৌষ । চিত্ত সেই একটা কেন্দ্রের চারিদিকেই বাধ পড়িয়া তাহার মধ্যেই আপনার সমস্ত বিসর্জন করিতে ও অন্তের সমস্ত নষ্ট করিতে চায়। এই উন্মত্ততার মধ্যে একদল লোক একরকমের সৌন্দৰ্য্য দেখে। এমন কি, আমারaমনে হয়, য়ুরোপীয় সাহিত্যে এই পাক-খাওয়া প্রবৃত্তির ঘূর্ণামৃত্যের প্রলয়োৎসব,—যাহার কোনো পরিণাম নাই, যাহার কোথাও শান্তি নাই,— তাহাতেই যেন বেশি মুখ পাইয়াছে। কিন্তু ইহাকে আমরা শিক্ষার সম্পূর্ণতা বলিতে পারি না, ইহা স্বভাবের বিকৃতি। সঙ্কীর্ণ পরিধির মধ্যে দেখিলে যাহাকে হঠাৎ মনোহর বলিয়া বোধ হয়, নিখিলের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলেই তাহার সৌন্দর্য্যের বিরোধ চোখে ধরা পড়ে। মদের বৈঠকে মাতাল জগৎসংসারকে ভুলিয়া-গিয়া নিজেদের সভাকুে বৈকুণ্ঠপুরী বলিয়া মনে করে, কিন্তু অপ্ৰমত্ত দর্শক চারিদিকের সংসারের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলেই তাহার বীভৎসত বুঝিতে পারে। আমাদের প্রবৃত্তিরও উৎপাত যখন ঘটে, তখন সে একটা অস্বাভাবিক দীপ্তিলাভ করিলেও বৃহৎ বিশ্বের মাঝখানে তাহাকে ধরিয়া দেখিলেই তাহার কুত্ৰত বুঝিতে বিলম্ব হয় না। এমনি করিয়া স্থিরভাবে যে ব্যক্তি বড়র সঙ্গে ছোটকে, সমগ্রের সঙ্গে প্রত্যেককে মিলাইয় দেখিতে না জানে, সে উত্তেজনাকেই আনন্দ ও বিকৃতিকেই সৌন্দর্য্য বলিয়া ভ্রম করে। এইজন্তই সৌন্দৰ্য্যবোধকে পুর্ণভাবে লাভ করিতে হইলে চিত্তের শাস্তি চাই ; তাহ অসংযমের দ্বারা হইবার জো নাই। * সৌন্দর্য্যবোধের সম্পূর্ণতা কোনদিকে চলিয়াছে, তাহাই দেখা যাক।