শেষোক্ত গ্রন্থখানি উল্লেখযোগ্য; ইহা সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় লিখিত আত্মকথা। রচনার নিদর্শনস্বরূপে ‘আমার জীবন’ হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি:
“আমার মা বলিলেন, এই যে, আমাদের দালানে ঠাকুর আছেন, তাঁহারি নাম দয়ামাধব, তিনি ঠাকুর। কল্য তোমাদের যে লোক নদীর কূল হইতে কোলে করিয়া বাটীতে আনিয়াছিল, সে মানুষ। তখন আমি বলিলাম, মা তুমি বলিয়াছিলে, ভয় হইলে দয়ামাধবকে ডাকিও, আমাদের দয়ামাধব আছেন। তবে যে কালি যখন ভয় হইল, আমরা দয়ামাধব! দয়ামাধব! বলিয়া কত ডাকিলাম, আইলেন না কেন? মা বলিলেন, ভয় পাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে দয়ামাধব! দয়ামাধব! বলিয়া ডাকিয়াছিলে। দয়ামাধব তোমাদের কান্না শুনিয়া ঐ মানুষ পাঠাইয়া দিয়া তোমাদিগকে বাটীতে আনিয়াছেন। আমি তখন মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, মা! দয়ামাধব দালানে থাকিয়া কেমন করিয়া আমাদের কান্না শুনিলেন? মা বলিলেন, তিনি পরমেশ্বর, তিনি সব স্থানেই আছেন, এজন্য শুনিতে পান। তিনি সকলের কথাই শানেন।
“সেই পরমেশ্বর আমাদিগের সকলকে সৃষ্টি করিয়াছেন। তাঁহাকে যে যেখানে থাকিয়া ডাকে তাহাই তিনি শুনেন। বড় করিয়া ডাকিলেও তিনি শুনেন, ছোট করিয়া ডাকিলেও শুনেন, মনে মনে ডাকিলেও শুনিয়া থাকেন। এজন্য তিনি মানুষ নহেন, পরমেশ্বর। তখন আমি বলিলাম, মা! সকল লোক যে পরমেশ্বর পরমেশ্বর বলে, সেই পরমেশ্বর কি আমাদের? মা বলিলেন, হাঁ, ঐ এক পরমেশ্বর সকলেরি, সকল লোকেই তাঁহাকে ডাকে, তিনি আদিকর্ত্তা। এই পৃথিবীতে যত বস্তু আছে, তিনি সকল সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি সকলকেই ভাল বাসেন, তিনি সকলেরই পরমেশ্বর।
“বাস্তবিক পরমেশ্বর যে কি বস্তু, তাহা আমি এ পর্য্যন্ত বুঝিতে পারি নাই। সকল লোক পরমেশ্বর পরমেশ্বর বলে, তাহাই শুনিয়া থাকি, এই মাত্র জানি। মা বলিলেন, তিনি ঠাকুর, এজন্য সকলের মনের ভাব জানিতে পারেন। মার ঐ কথা শুনিয়া আমার মন অনেক সবল হইল। বিশেষ সেই দিবস হইতে আমার বুদ্ধির অঙ্কুর হইতে লাগিল। আর পরমেশ্বর যে আমাদের ঠাকুর, তাহাও আমি সেই দিবস হইতে জানিলাম। আর আমার মনে অধিক ভরসা হইল। পরমেশ্বরকে মনে মনে ডাকিলেও তিনি শুনেন, তবে আর কিসের ভয়, এখন যদি আমার ভয় করে, তবে আমি মনে মনে পরমেশবর পরমেশ্বর বলিয়া ডাকিব। মার ঐ কথা আমার চিরস্থায়ী হইয়াছে, মা বলিয়াছেন, আমাদের পরমেশ্ববর আছেন।”