দেড় শত বৎসর পূর্বে—ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বঙ্গদেশে স্ত্রীশিক্ষার অবস্থা মোটেই উল্লেখযোগ্য ছিল না। প্রধানত সম্ভ্রান্ত পরিবারের অন্তঃপুর-প্রাচীর মধ্যেই ইহা সীমাবদ্ধ ছিল; মেয়েরা ঘরে বসিয়া শিক্ষয়িত্রীর সাহায্যে বিদ্যাচর্চা করিতেন। ‘সম্বাদ ভাস্কর’সম্পাদক গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ একবার স্ত্রীশিক্ষা প্রসঙ্গে লিখিয়াছিলেন:
“কলিকাতা নগরে মান্য লোকদিগের। বালিকারা প্রায় সকলেই বিদ্যাভ্যাস করেন, প্রাপ্ত রাজা সুখময় রায় বাহাদুরের পরিবারগণের মধ্যে বিদ্যাভ্যাস স্বাভাবিক প্রচলিতরূপ হইয়াছিল, বিশেষত রাজা সুখময় রায় বাহাদুরের পুত্র প্রাপ্ত রাজা শিবচন্দ্র রায় বাহাদুরের কন্যা প্রাপ্তা হরসুন্দরী দাসী সংস্কৃত, বাঙ্গালা, হিন্দী এই তিন ভাষায় এমত সুশিক্ষিতা হইয়াছিলেন পণ্ডিতেরাও তাঁহাকে ভয় করিতেন।...শ্রীযুত বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুরের জ্যোষ্ঠা কন্যা [সুরসুন্দরী দেবী] বর্তমানা থাকিলে মুক্তাশ্রেণীর ন্যায় তাঁহার অক্ষর শ্রেণী ও নানা প্রকার রচনা দেখাইয়া সাধারণকে সন্তুষ্ট করিতে পারিতাম...। শ্রীযুত বাবু আশুতোষ দেব [সাতু বাবু] মহাশয়ের কন্যা গৌড়ীয় ভাষা, উর্দ্দু ভাষা, ব্রজভাষায় সুশিক্ষিতা হইয়াছেন, এবং দেবনাগরাক্ষর লিখন পঠন বিষয়ে পণ্ডিতেরাও তাহার ধন্যবাদ করেন, বিশেষত শিল্পবিদ্যায় ঐ কন্যার যে প্রকার ব্যুৎপত্তি হইয়াছে অনুমান করি ইংলণ্ডদেশীয়া প্রধানা শিল্পকারিকারাও তাঁহার শিল্পকর্ম্মদর্শনে হর্ষ প্রকাশ করিবেন।” (৩১ মে, ১৮৪৯)
ইহা ত হইল সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের কথা। সাধারণ গহন্থ-পরিবারে মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না; বরং প্রাচীনাদের অনেকের বদ্ধমূল সংস্কার ছিল, যে-মেয়ে লেখাপড়া করে সে “রাঁড়” (বিধবা) হয়। এই শোচনীয় অবস্থার কথা স্মরণ করিয়াই রামমোহন রায় ১৮১৯ খীস্টাব্দে সহমরণবিষয়ে বাদানুবাদে এক স্থলে প্রতিপক্ষকে বলিয়াছিলেন:
“আপনারা বিদ্যাশিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বন্ধিহান হয় ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন?”
যে-সময়ে রামমোহন এই তিরস্কার-বাণী উচ্চারণ করেন, ঠিক সেই বৎসরেই কলিকাতায় সর্বপ্রথম প্রকাশ্য বালিকাবিদ্যালয়ের সচনা হয়।