পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S ૨૨ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড প্রায় ৩ ঘন্টা যাবত এইভাবে নির্যাতন চালানোর পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমার পায়ে চিকন রশি শূন্যে ঝুলিয়ে দেয়। এই সময় এমন লাগতে থাকে যে জীবন বোধ হয় পা দিয়েই বের হয়ে যাবে। ঝুলে থাকা অবস্থায় মোটা রোলার দিয়ে প্রত্যেক গিরায় গিরায় মারতো এবং মাথার পিছনের দিকে আঘাত করতো। প্রায় ২০ মিনিট রাখার পর আমি বলি যে, আমাকে মাটিতে নামান হলে আমি সব কথা বলবো। তখন তারা আমাকে নিচে নামায় এবং তখনই বলার হুকুম দেয়। কিন্তু আমি একটু জিরিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে আবোল তাবোল বলতে থাকি। আমার চালাকি বুঝতে পেরে বর্বর সৈন্যরা আমাকে লাথির পর লাখী মারতে থাকে। কিছুক্ষণ পিটানোর পর পুনরায় আমাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এবং পূর্বের চেয়ে আরও বেশী প্রহার করতে থাকে এবং প্রশ্ন করতে থাকে। আমার ঐ একই উত্তর যে আমি জানি না। ২য় বার আমাকে ঝুলানোর প্রায় ১৫/২০ মিনিট পর পাশের রুম থেকে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন বের হয়ে আসে এবং আমাকে বলে ছানোয়ার’, আমি একজন মুসলমান তুমি বিশ্বাস কর? আমি তার জবাবে বলি যে হাঁ আপনি মুসলমান। তখন ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে পুনরায় বলে যে ‘আমি মুসলমান হয়ে আর এক মুসলমানের কাছে প্রতিজ্ঞা করছি যে যদি তুমি আমার কাছে সত্য কথা বলো তবে তোমাকে আর মারা হবে না’, এবং আমি চেষ্টা করবো তোমাকে ছেড়ে দিতে “তখন আমার তার কথা বিশ্বাস হলো এবং আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম যে “আমি সত্য কথা বলবো?” এই সময় আমাকে মাটিতে নামান হয় এবং বলে যে তুমি “খাওয়া দাওয়ার পর বলবে না এখনই বলবে?” আমি বলি যে আপনি যা বলেন সেই হিসাবেই আমি কাজ করবো। তখন আমাকে রুটি ও তরকারি এনে খেতে দেওয়া হয়। খাওয়ার পর ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে জানায় যে তুমি আজ বিশ্রাম কর কাল তোমার কাছ থেকে সব কথা শোনা হবে। এই বলে আমাকে পুনরায় জেলে নিয়ে একটা সেলের ভিতর বন্দী করে রাখে। এই সময় আমি এত কাহিল হয়ে পড়েছিলাম যে আমি মোটেই নড়াচড়া করতে পারতাম না। ৪ঠা আগষ্ট সকাল ৯টার দিকে আমাকে জেল থেকে বের করে পূর্বের সেই ঘরে ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে প্রশ্ন করে যে, বল তুমি কি করেছো? তার উত্তরে আমি জানাই যে আমি ৭ দিন ট্রেনিং নিয়েছি। তারপর অপারেশনের জন্য আমরা বগুড়া যাবার পথে “গয়েশপুর” এসে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং আমার দলের লোক আমাকে রেখে বগুড়া চলে যায়। তখন আমি পুনরায় ভরতে চলে যাই এবং কিছু দিন পর যখন ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন তখন আমি দেশে ফিরে আসার সময় রাজাকারদের কাছে ধরা পড়ি। ক্যাপ্টেন আমার কথা লিখে নেয় এবং আরও বহু প্রশ্ন করে, ভয় দেখায়, লোভ দেখায় উত্তর দেবার জন্য। আমি বলি যে যদি আমাকে মারতে মারতে মেরেও ফেলা হয় তবুও আমি এর বেশী আর কিছু বলতে পারবো না। ৭ই আগষ্ট আমাকে বগুড়া জেল থেকে বের করে “মিলিটারী পুলিশ” হাত বেঁধে গাড়ীতে করে রেল ষ্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের কথা থেকে আমি বুঝতে পারি আমাকে নাটোর সামরিক জেলে পাঠান হচ্ছে। গাড়ী আসার পর মিলিটারী পুলিশ আমাকে অন্য মিলিটারীর হাতে তুলে দেয়। গাড়ীর ভিতর তুলে আমাকে ও অন্য আরও একটি ছেলেকে ছিটের নীচে বসিয়ে আমাদের ঘাড়ের উপর পা তুলে বর্বর সৈন্যরা বসে থাকতো। এবং প্রত্যেক ষ্টেশনে গাড়ী থামলে বিহারী ও অন্য সৈন্যরা এসে আমাদের দুই জনকে ভীষণভাবে মারধোর করতো। প্রত্যেক ষ্টেশনে আমাদের এই ভাবে নির্যাতন চলতে থাকে। নাটোর রেল ষ্টেশন থেকে আমাদের নাটোর সামরিক জেলের কাছে নিয়ে যায় এবং বলে যে এদেরকে নতুন “মেহমান” হিসাবে প্রাথমিকভাবে কিছু “খেদমত” করে দেওয়া হোক। এই বলে ভীষণ মারধোর আরম্ভ করে। মারতে মারতে প্রায় জ্ঞানশূন্য অবস্থায় আমাকে জেলের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়।