পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড

৷৷ ৮৬ ৷৷
ডাঃ আব্দুল করিম আহমদ
গ্রাম- সাপটানা
লালমনিরহাট, রংপুর

 ৪ঠা এপ্রিল ১৯৭১, হানাদার বাহিনীর লালমনিরহাট প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত লালমনিরহাট বাসভবনে ছিলাম। হানাদার বাহিনী প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আমি পূর্বদরজা গ্রামের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করি। কয়েক দিন পর গোপনে আমি আমার পরিত্যক্ত বাসভবন এবং ডিসপেনসারী দেখতে আসি। লালমনিরহাট শহরের পথিমধ্যে আমি অবাঙ্গালীদের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল দেখতে পাই। আমার বাসভবনে ঢোকার কিছুক্ষণ পর জনৈক ব্যক্তি আমাকে জানায় যে অবাঙ্গালীদের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল দেখতে পাই। আমার বাসভবনে ঢোকার কিছুক্ষণ পর জনৈক ব্যক্তি আমাকে জানায় যে অবাঙ্গালীরা আমাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে। এ খবর পেয়ে আমি পূর্বদিক দিয়ে দ্রুত বের হই। অবাঙ্গালীরা খোঁজ নিয়ে আমার পিছু নিয়েছিল। ৭ই জুলাই আমি যখন আমার পূর্বদরজা গ্রাম বাসভবনে কার্যরত ছিলাম, তখন বহু হানাদার সৈন্য বিভিন্ন দলবদ্ধভাবে তিন দিক থেকে আমার বাসভবন ঘিরে আসছে দেখতে পাই। হানাদার বাহিনী স্থানীয় অবাঙ্গালীদের নিয়ে বাড়ী ঘিরে ফেলে এবং লুটতরাজ শুরু করে। যাবতীয় মূল্যবান সামগ্রী তারা নিয়ে নেয়। ইত্যবসরে অপর একটি দল এসে পড়ে। উক্ত দলে লারমনিরহাট থানার জনৈক জমিদার ছিল। এই জমিদারটি জানায় যে, আমি কেন এখনও গ্রেফতার হইনি এবং আমাকে পাকিস্তানী পতাকা প্রজ্বলন এবং আওয়ামী লীগের একজন লীডার বলে অভিযুক্ত করে। হানাদার সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ধরে ফেলে এবং কিল, থাপ্পড়, ঘুষি, লাখি প্রভৃতি দ্বারা অবর্ণনীয় দৈহিক পীড়ন শুরু করে। অবাঙ্গলী চরেরা আমাকে গৃহ থেকে দুটি ভারতীয় তৈরী ঔষধ বের করে আনে। সেতুর কাছে অপর একদল সৈন্যের নিকট নিয়ে আসে। এখান থেকে লালমনিরহাটে ফোন করা হয়। কিছুক্ষণ পর দুটি কামরাসহ একটি রেল ইঞ্জিন সেখানে এলে হানাদার বাহিনীর কতিপয় লোক আমাকে লালমনিরহাটে নিয়ে আসে। এখান থেকে আমার চোখ বেঁধে এরোড্রাম ঘাঁটির নিকট হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এখান থেকে শুরু হয় আমার উপর দৈহিক নির্যাতন। এখানে আরো বহু লোককে নিয়ে আসা হয়েছিল। এই ঘাঁটিতে ১৪ দিন বন্দি জীবনযাপন করি। এই সময় আমাকে দিয়ে আবর্জনা পরিষ্কার, মাঠের কাজ, কঠোর পরিশ্রমমূলক কাজ ইত্যাদি করিয়ে নেয়া হতো। তা ছাড়া চড়, কিল, ঘুষি, লাথি প্রভৃতি অতি সাধারণ ব্যাপার ছিল।

 এরপর আমাকে স্থানীয় রেলওয়ে ট্রেনিং স্কুলে আনা হয়। সেখানে কয়েকটি হাজত কামরায় আরো ধৃত বাঙ্গালীদের দেখতে পাই। এখানেও আমাকে দৈহিক পীড়ন এবং কায়িক পরিশ্রমশীল কার্যে নিয়োগ করা হয়। এখানে অবস্থানকালে আমি দেখতে পাই বিভিন্ন স্থান থেকে নিরপরাধ বাঙ্গালীদের ধরে আনা হতো। বিহারীরা এদের উপর নানা প্রকার অশ্লীল মন্তব্য করতো। কখনো কখনো বিহারীরা ধৃত বাঙ্গালীদের উপর মিথ্যা অভিযোগ আনতো। সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালীদের ধরে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনী হত্যা করতো। এভাবে গণহত্যা ছিল নিত্যদিনের অতি সাধারণ ঘটনা।

স্বাক্ষর/-
ডাঃ আব্দুল করিম আহমদ