পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড

॥৮৮॥
নুর মোহাম্মদ
দিনাজপুর কারাগারের সিপাই

 সরকারী ও বেসরকারী কর্মচারীদের কাজে যোগদানের জন্য পাক সরকার যখন নির্দেশ দেয়, তখন আমি দারুন আর্থিক কষ্টের মধ্যে অজো পাড়াগাঁয়ে অবস্থান করেছিলাম। পেটের দায় বড় দায়। কাজেই উপায়ন্তর না দেখে আমি কাজে যোগদানের জন্য শহরে আসি এবং অন্যান্য সহকারীরা যোগদান করেছে কিনা দেখার জন্য জেলখানার সামনের গেট দিয়ে আসবার চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানে কারো পোষাক পরিহিত পাঞ্জাবী পশু ও তাদের অনুগ্রহপুষ্ট পদলেহী অবাঙ্গালীরা পাহারা দিচ্ছিল। সাহসে না কুলানোর জন্য আমি পেছনের অপ্রশস্ত রাস্তা দিয়ে ঢুকবার চেষ্ট করি। আর সে সময়ই জনৈক অবাঙ্গালী জেল হেড ওয়ার্ডার হানিফ খান আমাকে ধরে ফেলে জেল গেটে নিয়ে এসে হাত বেঁধে অমানুষিকভাবে হৃদয়হীন পদ্ধতিতে প্রহার শুরু করে। কিল, ঘুষি ও বুট দিয়ে লাথি মারে। প্রহারের চোটে আমি যখন অত্যন্ত কাতর হই, তখন আমাকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। যাবার পথে আমাকে সমানে প্রহার করা হয়। রাস্তার মাঝে আমার নাক ও মুখ জুড়ে এমন এক ঘুষি মারে যাতে আমার নাক ফেটে দরবিগলিত ধারায় রক্তপাত শুরু হয়। সে অবস্থায় আমাকে যখন থানায় নেয়া হয় তখন ঐ পশুরা আমি তখনও পান চিবোচ্ছি বলে রহস্য করে এবং প্রহার করতে থাকে। সেখানে ঘণ্টা খানেক ঐরূপে বিরতিহীনভাবে মারধর করার পর আমাকে ক্যাণ্টনমেণ্টে খান সেনাদের হাতে সোপর্দ করে।

 ক্যাণ্টনমেণ্টে নেবার পর জেলখানর অবাঙ্গালী সিপাই যারা মুক্তিফৌজের হাতে নিহত হয়েছে, তাদের পরিবারে মহিলারা জবানবন্দি দেয় যে “ইয়ে শালা সতরা-আঠারো আওরতকো বেওয়া কিয়া। ইয়ে হামারা শওহরকো মারা, হামারা ভাইকো মারা।”

 এ বক্তব্য শোনার পর পাক সৈন্যরা আমার উপর অমানুষিকভাবে প্রহার শুরু করে। আমাকে কেটে লবণ লাগিয়ে আস্তে আস্তে কষ্ট দিয়ে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয়। তারা আমাকে নিয়ে ফুটবল খেলার মত বেশ কিছুক্ষণ খেলাও করে। এ সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। অত্যাচারের এ পদ্ধতিতে তারা যখন তুষ্ট হয়ে যায়, তারপর আমাকে মেজর কামরুজ্জামানের নিকট নিয়ে যায়। সে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে এবং বলে যে তুমি কতজন বিহারী মেরেছ? নেতিবাচক উত্তর দিলে আমার বাঁধন খুলে দিতে বলে এবং আমাকে, একজন ডাক্তার ও আর এক ব্যক্তিকে জীপে তুলে নিয়ে মেজর নিজে গাড়ি চালিয়ে জেলখানায় আসে। আমাকে আলাদা রুমে বন্ধ করে রাখার নির্দেশ দেয়। সেখানে দু মাস বন্দি থাকার পর একদিন চা খাবার নাম করে বাইরে এসে পালিয়ে যাই।

স্বাক্ষর/-
নূর মোহাম্মদ