পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড

॥ ৯৭ ॥
মো: হাসেম আলী তালুকদার
গ্রাম রামচন্দ্রপুর
থানা ও জেলা পাবনা

 ১৯৭১ সালের রমজান মাসের প্রথম দিকে পাবনা শহর থেকে বহু খান সেনারা এসে গ্রাম ঘেরাও করে রাত্রির অন্ধকারে। আমার বাড়ীতে আমি ও আমার রুগ্ন স্ত্রী ছাড়া কেউ ছিল না। খান সেনারা আমাকে গিয়া ডেকে ঘর থেকে বার করে। ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুইজনকে বেদম প্রহর করে আর বলে “তুই মুক্তিবাহিনীকে খেতে দিস বল তারা কোথায়”। সেই সঙ্গে আরো আমাদের গ্রামের লোককে ঘরে নিয়ে ক্যাম্পে আসে এবং সেখানে কয়েক জনকে হত্যাও করে। স্ত্রীর পরিস্থিতি কি তা আর জানতে পারি নাই। ক্যাম্পে নিয়ে এসে আমকে এবং অন্যান্য জায়গার ৫ জনকে এক ঘরে রাখলো। দৈনিক সকাল দুপুর ও বিকাল এবং ১১/১২ টার দিকে দুই থেকে তিনজন এসে পরপর ঘর থেকে একজন পরে বার করে নিয়ে যেত এবং নানা জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তাদের খুশীতে কাউকে মারতে আবার কাউকে না মেরেই ঘরে রেখে যেত।

 আমাদের কয়েকজন কড়া পাহারাদার ছিল। রোজ তারা রাখতে দিত না বলতো রোজ আবার কি জিনিস। দৈনিক দুইবার করে আমাদের ৬জনকে একই জায়গায় কাপড়ে অথবা পাকা মেঝের উপর খাবার দিত। পুরাতন রেশন চাউলের ভাত আর খেসারী কলাইয়ের ডাল। গন্ধে আমরা কেউ খেতে পারতাম না। প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক ধরে আনতো এবং রাত্রি বেলা তাদের ক্যাণ্টমেণ্ট থেকে কিছু দূরে শব্দ শুনা যেত। অনেক চেনামুখ আর দেখতে পেতাম না। ১৪দিন আমাকে তারা প্রহর করার পর ১৫ দিনের দিন তাদের অফিসার সহ ৫জন এসে ঘর থেকে আমকে বার করে নিয়ে যায় এবং আমাকে মুক্তবাহিনী সম্পকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর কোন সন্ধান না পাওয়ার মোটা রশি নিয়ে এসে আমার দুই হাত গাছের দুই ডালের সাথে এবং দুই পায়ে রশি লাগিয়ে মাটিতে খুঁটি পুঁতে ভীষণ প্রহর করে। তাদের গ্রহর অজ্ঞান হলে তারা কি করেছে জানি না। তবে যখন আমার জ্ঞান হয় তখন দেখি আমার হাতের ও বাম উরুর চামড়া ছিলিয়ে আছে। ১৭ দিনের দিনগত রাতে আনুমানিক ২টার আমার ঘরের ও পাশ্বের ঘরে হতে ২৪/২৫ জনকে তাদের ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে কিছু দূর নিয়ে যায়। সবাই লাইন করে এক সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার গায়ে গুলি লাগে না তবু ও মরার মত পড়ে যাই। খান সেনারা চলে গেল প্রায় ভোরের দিকে কোন রকমে এক লোকের বাড়ী আশ্রয় নেই এবং সেখান থেকে আমার আত্মীয়কে খবর দিই নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাড়ী গিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে আর সাক্ষাৎ ঘটে নাই। তখন সে মারা গিয়েছিল।

স্বাক্ষর /-
হাসেম আলী তালুকদর