পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/২৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૭૦ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড l S○h l আজাহার আলী ১৯৭১ সালের ২৭শে এপ্রিল পাক বাহিনী ঝালকাঠি শহরে আসে। এসেই তারা ঝালকাঠি শহরে আগুন দিয়ে সমস্ত শহরটা পুড়িয়ে দেয় এবং গণহত্যা শুরু করে। পাক বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আমার ছেলে মোঃ সাত্তার নিজ গ্রামে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে ৭ই আষাঢ় বেশাই খান গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ঐ দিন ঝালকাঠি ও স্বরূপকাঠি থানার পাক বাহিনী বেশাই খান গ্রামে গিয়ে উক্ত গ্রামটা সম্পূর্ণ ঘিরে নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে দেয়। তারপর পাক বাহিনী হতে আমার ছেলে সাত্তারসহ মোট ৫৫ জন যুবক ছেলেকে ধরে। এবং জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে রাইফেল কোথায়? শরোজ বাবু কোথায়? এই কথা বলতে তাদের মধ্যে হতে ১৩ জনকে একটা খালের পারে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে এক এক করে গুলি করে হত্যা করে খালের মধ্যে ফেলে দিয়ে আসে। আর ৪২ জনকে গরুর দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝালকাঠি নিয়ে আসার এসিড মাখিয়ে দেয়। তারপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে এখনো বলো শরোজ কোথায়, তার পরিবার কোথায় এবং মুক্তিবাহিনী কোথায়? সাত্তারের শরীরের এসিড মাখিয়ে দেয় আমাদের স্থানীয় এলাকার দুইজন কুখ্যাত মুসলিম লীগের দালাল চেয়ারম্যান আজহার কারিগর ও শাহাজউদ্দিন সরদার (সাজি)। তারপর তাদেরকে থানায় নিয়ে এসে হাজত ঘরের মধ্যে রেখে দেয়। পরদিন সকাল বেলা আমি বাজারে এসে শুনতে পাই যে আমার ছেলে সাত্তারকে স্থানীয় দালালদের নির্দেশে পাক সেনারা তাকে ধরে ঝালকাঠি থানায় নিয়ে গেছে এবং ভীষণ প্রহার করেছে। তারপর আমি থানায় চলে যাই এবং আমার ছেলে সাত্তারের সাথে দেখা করি। সাত্তার তখন আমাকে বলে পাক সেনারা আমাকে গুলি করে না মারলেও দালালরা আমাকে রক্ষা করবে না। তাই আপনি তাদের কাছে আমার জীবন ভিক্ষা চেয়ে দেখেন তারা কি বলে। আমি দালালদের নিকট চলে আসি এবং তাদের পায়ের উপর কেদে পড়ে আমার ছেলের জীবন ভিক্ষা চাইলে তারা আমাকে লাথি দিয়ে দূরে ফেলে দেয় এবং বলে আগামীকাল সকাল বেলা এসো। তারপর আমি বাড়ী চলে যাই। ঐ দিন রাত্রিতে আমার ছেলে সাত্তারসহ ২৮জনকে নদীর ধারে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে লাইন করে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ভোরে আমি তাদের নিকট গেলে তারা আমাকে বলে তুমি গত রাত্রিতে গুলির শব্দ শোন নাই? তোমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একথা শোনার সাথে সাথে আমি অজ্ঞান হয়ে সেখানে পড়ে যাই। ২০/২৫ মিনিট পর আমার জ্ঞান ফিরলে আমি সাত্তারের লাশের জন্য থানায় অনুমতির জন্য যাই। তখন থানায় পুলিশকে নির্দেশ দেয় আমাকে গুলি করতে। এবং আরও বলে সে যদি এখান হতে চলে না যায় তাকে গুলি করে হত্যা করবে। তারপর আমি সেখান হতে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী চলে যাই। আমার ছেলের মরা লাশ সেখানে পড়ে থাকে। আমি বাংলাদেশের একজন গরীব কৃষক। দুটা ছেলের মধ্যে মাত্র একজন ছেলে বর্তমানে বেঁচে আছে। মাত্র দুই বিঘা জমি আমার। কিন্তু সংসারে ৭/৮ জন লোক। অতি কষ্টে ছেলেটাকে বি, এ, পর্যন্ত পড়া লিখা শিখিয়েছিলাম। সে ছেলেকেও হারালাম। স্বাক্ষর/আজহার আলী ১৭/৮/৭৩