পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩২৬

নির্বিচারে এভাবে মারতে দেওয়া যাবে না। সাবধান হও জল্লাদ। শেখ সাহেবের বাড়ীতেই খবর পেলাম সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া- ভুট্টো ঢাকার প্রেসিডেণ্ট হাউস আর ইণ্টারকণ্টিনেণ্টাল থেকে ক্যাণ্টনমেণ্ট গিয়ে টিক্কা, ওমর, পীরজাদা, ফরমান আলী, হামিদ, খাদিম হোসেন রাজা এসবদের নিয়ে মিটিং করছে- সলাপরামর্শে বসেছে। শেখ সাহেবের প্রেস ব্রিফিংয়ের পর সেলিম ভাই, আমি আর সেলিম মামা হাঁটতে হাঁটতে এসেছিলাম নিউমার্কেট পর্যন্ত। নিউমার্কেট থেকে একবার সার্জেণ্ট জহুরুল হলে গেলাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। মন এক বিরাট আশঙ্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেলো। অফিসে এসে একটা লেখা শেষ করছি। তারপর খেতে গিয়ে তো এ কাণ্ড।

 সে রাতে আর কোন কাজ হলো না- কোন পত্রিকা বেরোলা না পরদিন। সারা রাত অফিসে আটকা থাকলাম। জল্লাদরা কারফিউ জারী করেছে। পরদিনও সেই অবস্থা। তবে রাজারবাগে বোমার আওয়াজ কমেছে কিছুটা। কিন্তু গুলীর আওয়াজ থামেনি। থামেনি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার আর্তনাদ। দূরে তিন-চার জায়গায় দেখলাম বিরাট বিরাট কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। বুঝতে পারলাম স্বদেশেও যারা মোহাজির সেসব রিকশাওয়ালা-মুটে-মজুর আর কুলী-কামিনদের বস্তীগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে জল্লাদের দল।

 ছাব্বিশে মার্চ নয়টায় ঢাকা বেতার থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় জনৈক উর্দুভাষী এলাম ফরমাইছেন, টিক্কা ঢাকা শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারী করেছে। আর অনেক নতুন সামরিক আইন জারী করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এর কয়েক মিনিট পরেই তদানীন্তন চতুদর্শ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারের সামরিক পাবলিক রিলেশসন অফিসার মেজর মোহাম্মদ সাদিক সালিক এক বিরাট পরোয়ানা নিয়ে অফিসে হাজির। ওর দাবী গুলো বাংলায় অনুবাদ করে প্রচার পত্র হিসাবে ছেপে দিতে হবে। সালিকের সাথে স্টেনধারী আরো তিন পাষণ্ড। আমরা বললাম, এসব ছাপার মালিক আমরা নই। হামিদুল চৌধুরী সাহেব বা মাহবুবুল হকই পারে। ওরা চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর মাহবুবুল হককে নিয়ে ফিরে এলো। মাহাবুবুল হক ছাপতে রাজী হলো- আমাদের অনুবাদ করে দিতে বললো। আমরা জবাব দিয়েছিলামঃ ক্ষুন্ন পিপাসা আর নিদারুণ উদ্বেগে আমরা ক্লান্ত। এখন অনুবাদ করতে পারবো না। মাহবুবুল হক এতে সালিককে কি যেনো বললো। সালিক আমাদের ধমক দিয়ে বললো- জলদী করো না- নেহী তো দেখতা হায় পেছনের তিন পাষণ্ডকে দেখালো। অগত্যা অনুবাদ করে দিলাম। পরে অবশ্য সে অনুবাদের প্রচারপত্র ছাপা হয়নি। এরপর ওরা মাহবুবকে নিয়ে আবার চলে গেলো। আমরা অফিসেই বন্দী রইলাম।

 এগারোটার দিকে রফিক কোথা থেকে কয়েকটা পাউরুটি আর বনরুটি জোগাড় করেছিলো। সেগুলো দিয়ে কোন মতে কিছুটা ক্ষুধা নিবারণ করলাম। এ সময় দেখি বেতার থেকে বার বার আমার সোনার বাংলা গানটির দু'তিন পঙক্তি বাজানো হচ্ছে।

 পঁচিশে মার্চ রাত থেকে সাতাশে মার্চ- সকালে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত আটকা পড়েছিলাম সেই পূর্বদেশ অফিসে। সাতাশে মার্চ সকালে ঢাকা বেতার থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় জনৈক উর্দুভাষী ঘোষনা করলো, টিক্কা দুপুর বারোটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল, করেছে। যে যার ঘরে ফিরতে পারবেনপারবেন বারটা পর্যন্ত হাট বাজার করতে। তারপরই আবার স্বগৃহে অন্তরীণের পালা শহরবাসীদের। ঘোষনাটি শোনার পর আমরা অবজারভার ভবনে চার দেওয়ালে ভেতর আটকা পড়া লোকগুলো বেরুলাম। রাস্তায় হেঁটেই যেতে হবে, কেননা রাস্তায় দখলদার বাহিনী বিরাট বিরাট লরী আর জীপ ছাড়া অন্য কোন যানবাহন নেই। মহানগরী ঢাকার রাস্তাগলি সকল রকমের যানবাহন শূন্য। মতিঝিল থেকে রায়ের বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ এ মাইলের মধ্যে রাস্তায় একটা রিকশাও আমার চোখে পড়েনি।

 রাস্তায় দেখলাম ঘরে ফেরার মানুষগুলোর সে কি ঊর্ধ্বশ্বাস চলা। কারো দিকে কারো তাকাবার সময়টা পর্যন্ত নেই। সবাই ছুটছে কোনমতে নিজের জানটুকু নিয়ে যেভাবে পারছে পালাচ্ছে। থেকে থেকে পাষণ্ডদের লরীগুলো বিরাট দানবীয় শক্তিতে ছুটে চলেছে রাস্তার দু'পাশের মানুষ আর ঘরবাড়ী কাঁপিয়ে।