পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩২৭

 প্রতিটি গাড়ীর ওপরে পজিশন নিয়ে বসে আছে- চারিদিকে তাক করে রেখেছে মেশিনগান, হাল্কা মেশিনগান আর কামানের মুখ। ওদের এহেন সতর্ক মহড়া দেখে সেই সদা আতঙ্কিত মনেও হাসি এলো আমার। কার বিরুদ্ধে এমন সতর্কতা? বাংলাদেশের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর দাবীদারদের এহেন একতরফা বীরত্ব যদি সেই মুহূর্তে আমার কাছে হাস্যস্পদ বলে মনে হয়, তবে কি।

 অবজারভার ভবন থেকে বেরিয়ে দুদিনের উপোসী ক্লান্ত দেহটাকে টেনেহিঁচড়ে যখন ন্যাশনাল কোচিং সেণ্টারের সামনে হাজির হলাম, তখন অনেকটা সংজ্ঞা লোপ পাবার অবস্থা। কোচিং সেণ্টারের ঠিক সামনেই ফুটপাতের ওপর দেখলাম একটা মানুষের লাশ। গুলীর আঘাতে বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। পাশেই পড়ে রয়েছে কিছু নাড়ি-ভুড়ি। নাকে আঙ্গুল এঁটে- চোখ দুটো বন্ধ করে পাশ কাটাতে চাইলাম। কিন্তু পা এগুচ্ছিল না। হাঁটু দুটো কাঁপছে থর থর করে। নার্ভাস হয়ে গেলাম। তবুও এগিয়ে যেতে হলো।

 একবার মনে করলাম রাস্তায় নেমে যাই। ফুটপাতে হাঁটতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু পারলাম না। রাস্তার ওপর দিয়ে পশুদের দানবীয় লরীগুলো যেভাবে ছুটছে- যে কোন সময় তার তলায় পিষ্ট হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়। বুক সেণ্টারের সামনের ফুটপাতে দেখতে পেলাম চাদর মুড়ি দেওয়া আর একটি লাশ। ওর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম। বায়তুল মোকাররমের মোড়ে রাস্তায় ওপর আরো দু'টো নাম না জানা বাঙ্গালী বীরের নশ্বর দেহ চোখে পড়লো চোখে পড়লো জি,পি,ও’র পেছনের গেটে এক ঝুড়ি রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড আর নারী-ভুঁড়ি। তবুও আমি হেঁটে চলেছি-হেঁটে চলছেন আমার চার পাশের মানুষগুলো। কেননা, আমি এবং আমার চার পাশের মানুষগুলো আমরা সবাই তখন বাঁচতে চাই। এবং সে জন্যই আমাদের কারো প্রতি কারো কোন খেয়াল নেই কারো সাথে কারো কোন কথা নেই। সবাইর চোখেই একটা সন্ত্রস্ত ভাব। সবাই ভীতি বিহ্বল।

 এ লাশগুলো দেখার পর চলার পথে আমার অবচেতন মনে বারবারই দৃশ্যগুলো ফুটে উঠতে লাগলো- মনকে বাঁধতে চাইলাম- রাস্তায় আর কিছুর দিকে তাকাবো না- কেবল নিজের পদক্ষেপের জায়গাটুকু ছাড়া- কেননা আমার অনুভূতি তখন ভোঁতা হতে শুরু করেছে- প্রচণ্ড অন্তর্যাতনায় আমি যেন উদভ্রান্ত। পুরানা পল্টন মোড় পেরিয়ে সেক্রেটারীয়েটের ফুটপাতে উঠলাম। ক্যাপ্টেন রেষ্টুরেণ্টের বিপরীত দিকের রাস্তায় ডাষ্টবিনের পাশে দেখলাম আর একটা বাঙালীর লাশ। হাতে সোল মাছের একটি কাঁচা মাথা মুষ্টিবদ্ধ। ক্যাপ্টেনওয়ালারা মাছের মাংসটা রেখে মাথাটা ডাষ্টবিনে ফেলে দিল, কোন বুভুক্ষ হতভাগ্য হয়তো বা সেই মাথাটা কাক- কুকুরের সাথে ঝগড়া করে অধিকার করেছিলো কিন্তু নিয়ে যেতে পারেনি- দখলীকৃত সেই উচ্ছিষ্ট মাথাটা হাতে থাকতেই সে হয়েছে জল্লাদ পাশবিক শক্তির উন্মত্ত শিকার। আর পা চলে না- ইচ্ছে হলো ওখানেই বসে পড়ি।

 পেসক্লাবের সামনে দিয়ে পেরুতেই একবার ক্লাব প্রাঙ্গণের দিকে তাকালাম- দেখলাম ফয়েজ ভাইয়ের (বর্তমান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্তার প্রধান) পুরানো গাড়ীটা পড়ে রয়েছে। ক্লাবের পশ্চিম পাশের বাড়ীর আঙ্গিনা ভর্তি পশুদের ছাউনি-ওপাশে কমিশনার অফিস প্রাঙ্গণে ভর্তি জল্লাদের দল। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। হঠাৎ এক পথচারীর ডাকে সম্বিত ফিরে আবার চলতে শুরু করলাম।

 নতুন হাইকোর্ট ভবনের সামনে দিয়ে রমনা পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি- আমি যেন মানুষ নই- দমদেয়া কোন যন্ত্র মাত্র। রমনা রেসকোর্সের পাশে এসে আর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে সাহস হলো না- অন্ততঃ মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে ওদের লরীগুলো যদ্দুর সম্ভব এড়িয়ে চলা যাবে, তাই করলাম। রেসকোর্সের মধ্য দিয়ে হাঁটছি- আর আমার সম্ভ্রম চেতনায় ভাস্বর হয়ে উঠছে- মাত্র আঠারো দিন আগের একটি স্মৃতি। এই সেই রেসকোর্স- যেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেনঃ এবারের সংগ্রাম- মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটি বিরাট মঞ্চ- সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছেন বঙ্গবন্ধু- মাঠ ভর্তি লোক, এক জনসমুদ্র। আমি সেই সমুদ্রের মাঝ দিয়ে টছি- হঠাৎ মনে হলো