পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩২৯

 রায়ের বাজারে নদীর ধারে গিয়ে দেখলাম এক অভূতপূর্ব মর্মান্তিক দৃশ্য। প্রাণভয়ে মানুষ যে কত অসহায়, কত কষ্ট স্বীকার করতে পারে এটা তারই একটা প্রতিচ্ছবি। কাঁধে ঘাড়ে হাতে ছোট ছোট বাচ্চা আর পোঁটলা পুটলীসহ এক কোমর থেকে এক বুক পানি ভেঙ্গে নদী পার হচ্ছে হাজার হাজার নরনারী। প্রাণ বাঁচানোর আকুল চেষ্টায় ধাবমান অনেকেরই ইজ্জত- আব্রুর দিকে কোন খেয়াল নেই। যেসব গৃহবধুকে সেদিন রাস্তায় এবং নদী পার হবার সময় এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখেছি তাদের অনেকেই কোন দিন সূর্য্য দেখেছেন কি না বলা যায় না। অনভ্যস্ত পদে তাড়াহুড়ো করে পথ চলতে গিয়ে কত মহিলা ও শিশু যে হোঁচট খেয়ে পড়ে, পা ভেঙ্গেছেন, কতজনের যে নখ উল্টে গেছে- তার খবরই বা কে রাখে। আমার আত্মীয় সেদিন এমনিভাবে পালাবার সময় আছাড় খেয়ে পড়ে পায়ের নলার হাডডি দু'টো ভেঙ্গেছে- এখনও তিনি হাঁটতে পারছেন না কোনদিন পারবেন কিনা বলা শক্ত।

 বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাঙ্গালী হয়ে বাংলাদেশের বুকে বাংলারই মা-বোন আর বাচ্চাদের এ মর্মান্তিক অবস্থা দেখতে পারিনি- পারিনি সহ্য করতে-নিজের অক্ষমতার আত্মদহনের জ্বলে মরেছি কেবল। বিকেল চারটা বাজতে না বাজতেই হার্মাদের বিরাট বিরাট লরীগুলো ঐ এলাকার রাস্তা এবং ছোট ছোট জীপগুলো অলি-গলিতে ছুটোছুটি শুরু করলো। আমরা সবাই আবার গৃহে অন্তরীণ হলাম। চারটার কয়েক মিনিটের মধ্যেই নদীর পাড়ের দিকে বেশ কয়েকটা গুলীর আওয়াজ শুনতে পেলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম, যে হতভাগীরা জানের ভয়ে শহর ছেড়ে পালাচ্ছিলো তাদের ওপরই হার্মাদরা নির্বিচারে গুলী চালিয়েছে- কতজন যে সেদিন এখানে সেখানে শহীদ হয়েছেন কেউ তার কোন হিসাব জানে না কোন দিন কোন ইতিহাসেও হয়তো বা ওদের কথা আর কেউ লিখবে না।

 সন্ধ্যায় ঘরে বসে বসে বহু কষ্টে স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর ধরতে সক্ষম হলাম। সেই প্রথম শুনতে পেলাম এই বেতারে খবর শুনতে পেলাম ঘোষকের আনাড়ি কণ্ঠে যে, বঙ্গবন্ধু ২৬শে মার্চ ভোরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন এবং তিনি মুক্তিবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিরাপদে রয়েছেন। এই কথাটা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম আনন্দিতও হলাম। অবশ্য পরে শেষোক্ত ঘোষনাটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। রাত যতই বাড়তে লাগলো সারা এলাকাজুড়ে জল্লাদদেরও তাবলীলা আরো বাড়তে শুরু করলো। রাত ১১টার দিকে আমার বাসার সামনের গলির মুখের বাসা দু'টোয় ওরা দু’দল ডুকলো, এ বাসা একটি কুমোরদের। অপরটিতে থাকেন দু'টো রিক্সাওয়ালাদের পরিবার। রিক্সাওয়ালাদের বাসা থেকে এরা দু'জন তরুণীকে ধরে নিয়ে গেলো। মুসলমান ধর্মের ধজাধারী ইয়াহিয়া-টিক্কা-ভুট্টোর হার্মাদ বাহিনীর পাশবিকতার যূপকাষ্ঠে দু'জন বাঙ্গালী নিঃসহায় তরুনীর একমাত্র সম্বল নারীত্ব ভূলণ্ঠিত হলো।

 কুমোরদের বাসায় ঢুকে ওরা প্রথমে ভাঙ্গলো ওদের ঠাকুর ঘরের দেবী-প্রতিমাগুলো। তারপর ঢুকলো অভ্যন্তরে। বাড়ীর ভেতরে ঢুকে ঘর থেকে টেনে বের করলো ১০ থেকে ৬০ বছর বয়সের সকল পুরুষকে। ও বাড়ীর একজন বধূ ও একজন মেয়েকে ধর্ষণ করলো তাদের স্বামী, মা- বাবা আর শ্বশুড়শাশুড়ির সামনে। এক জল্লাদ ঘুমান্ত একটি বছর দেড়েকের বাচ্চার বুকে ঢুকিয়ে দিলো তার সুতীক্ষ্ণ বেয়নেট। তারপর বেয়নেটের আগায় জুলিয়ে রাখলো ওর কচি দেহলতাটিকে। চোখের সামনে দেখলাম, সেই অবুঝ শিশুর হাড়-গোড়গুলো ঝুর ঝুর করে পড়ছে জল্লাদদের হাতে ধরা রাইফেলের গা বেয়ে। বেশীক্ষণ আর সহ্য করতে পারিনি। বাসার পেছনের চোরাগলি পথে দাঁড়িয়ে দেখলাম সে দৃশ্য। আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। আজো ভাবী এসব দেখে কি করে সহ্য করেছি- কেন পাগল হয়ে গেলাম না। কেন আমি মানুষ হয়ে জন্মালাম!

 কুমোরদের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে আসার সময় হঠাৎ ওরা এসে থমকে দাঁড়ালো ওদের পাতিল পোড়ানোর সেই বিরাট বিশাল অগ্নি কুগুটির সামনে। বাড়ীর সবাইকে বন্দুকের নলের মুখে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করলো ওটা কি? কুমোর কেউ তো উর্দু জানে না বলতেও পারে না তবুও ওরা বর্বর খান সেনাদের বোঝাতে চেষ্টা করলো। এক বর্ণও বাংলা জানা অথচ বাঙ্গালীর দরদের খান সেনারা তার একটা কথাও বুঝলো না