পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩৪৫

বাহিনীর বর্বর হামলার আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এখনও মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না। একি সত্যি, না স্বপ্ন, না কোন ঘোরের মধ্যে সে সময়টা কাটিয়েছি। আমি থাকতাম জগন্নাথ হলের দক্ষিণ ভবনের দ্বিতলে, ২৩৫ নং কক্ষে। মার্চের শুরুতেই ঢাকা শহর উত্তপ্ত ছিল। ঘটনা প্রবাহ খুব দ্রুত গতিতে এগুচ্ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মানুষ নতুন নতুন খবর শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। শহরে নানা রকম জল্পনা-কল্পনার মধ্যে ঐ দিনটিও গড়িয়ে যাচ্ছিল। আমিও সমস্ত দিন মিটিং, প্যারেড মিছিল করে রাত ১১টার দিকে হলে ফিরলাম। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অল্পক্ষণের মধ্যে। হঠাৎ মাথার কাছাকাছি বোমার এক বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সজাগ হয়েই শুনি চতুর্দিকে শুধু গগনবিদারী টর টর পর শব্দ আর মাঝে মাঝে সে শব্দকে ছপিয়ে গুর গুর গুরুম শব্দ এবং দালান কোঠা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিল হলের পুরান দালান বুঝি এক্ষুণি ভেঙে পড়বে। এমন গোলাগুলির শব্দ জীবনে শুনিনি, কল্পনাও করতে পারিনি। এই অবস্থার মধ্যে পড়ে প্রথমে একটু ঘাবড়িয়ে গেলাম। কি করা দরকার বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। সঠিক কিছু স্থির করতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। নুয়ে নুয়ে দক্ষিণ দিকের সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠলাম। সেখানে সিঁড়ির কাছে আরো কয়েকজন ছাত্র জড়ো হয়েছিল আগেই। সুশীলকে খুঁজলাম। দেখলাম তিন তলার সিঁড়ির কাছে তার রুম তালা বদ্ধ। সুশীল ছিল আমাদের হলের সহ-সম্পাদক। পরে শুনেছি সে গুলাগুলির শুরুতেই মেইন বিল্ডিং (উত্তর ভবন)এ চলে গিয়েছিল এবং সেখানে মারা গেছে। কেউ কেউ ছাদে ওঠার কথা বললো আমাকে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমি তিন তলার বারান্দা দিয়ে নুয়ে নুয়ে উত্তর দিকে লেট্রিন ও বাথরুমের কাছে গেলাম। দেখি উত্তর বাড়ীর সমস্ত আলো নিভানো। মিলিটারী হলে ঢুকে টর্চের আলোতে ছাত্রদের খুঁজে খুঁজে বের করে এনে সামনের মাঠে শহীদ মিনারের কাছে গুলি করে মারছে। এক একটা ব্রাশ ফায়ার করছে আর চিৎকার করে কতগুলি তাজা প্রাণ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছিল। কেউ দৌড়ে পালাতে চেষ্ট করতেই তাকে সে অবস্থায় গুলি করে মারছে। এখনও ভাবতে পারি না এ দৃশ্য এতো বাস্তব ও জীবন্ত, তবুও মনে হয় স্বপ্ন। মাঝে মাঝে দালানের উপর ভারী কামানের গোলাবর্ষণ হচ্ছে। কোন কোনো স্থানে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। এক সময় এসেম্বলির সামনে ডাইনিং হলটি জ্বলতে দেখলাম। উত্তর বাড়ীর কয়েকটি বাড়ীর কয়েকটি রুমেও আগুন দেখলাম। মাঝে মাঝে উপর থেকে নীচে সবুজ ও লাল রং-এর আলোর গোলা নামতে দেখছি। তখন চতুর্দিক আলোকিত হয়ে উঠছিল। আর সেই আলোতে দেখা গেল উত্তর বাড়ীর সামনের মাঠে শত শত মিলিটারী মেশিনগান ও ভারী কামানের গোলাগুলি বর্ষণ করছে নির্বিচারে। এক সময় দেখলাম এক একটি গাড়ির বহর হেড লাইট বন্ধ করে থেকে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ থেকে আবার চলে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ দেখে নিচ্ছে ঠিক ঠিক গুলি হচ্ছে কিনা, মানুষ মরছে কিনা। হঠাৎ এক সময়ে দেখা গেলো সলিমুল্লাহ হলের দিক থেকে ৪০/৫০ জন মিলিটারী দক্ষিণ বাড়ীর ঘরের দিকে এলো এবং দরজা ভেঙে খাবার ঘরে ঢুকল। খাবার ঘরের আলো জলল এবং এলোপাতাড়ি জানালা কাটের উপর গুলি ছুড়তে লাগলো। কয়েকজন চীৎকার করে মারা গেলো বুঝতে পারলাম। এক সময় দক্ষিণ বাড়ীর দারোয়ান প্রিয়নাথকে দিয়ে বেরিয়ে এলো মেশিনগানের মুখে। তাঁকে দিয়ে মেইন গেট পশ্চিমদি দিক দিয়ে খুলিয়ে ঢুকে পড়লো হলের মধ্যে। তখন আর আমি মিলিটারীদের দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি প্রথমে লেট্রিনে ও সেখান থেকে জানালা পেরিয়ে তিন তলার কার্ণিশে গেলাম ও শুয়ে পরলাম। সেখানে কয়েকটি শাল গাছ ছিল। একটি মোটা ডাল (শাখা) কার্নিশের কাছে নুয়ে ছিল। একবার ভাবলাম গাছে উঠি। শেষ পর্যন্ত গাছে না উঠে কার্নিশেই শুয়ে থাকলাম। হলের মধ্য তখন শুধু গুলির শব্দ আর চীৎকার শোন যাচ্ছিল। একতলা, দোতলা করে এভাবে ওরা তিন তলায় উঠল বুঝলাম। এক সময় আমার কাছেই কয়েকটি গুলির শব্দ হল। আমার মাথা সোজা দেয়ালের বিপরীত দিকে একটা লোক গোঙ্গাচ্ছে শুনতে পেলাম। আমি তখন ভাবছি কখন আমাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসে। কিন্তু আমাকে ওরা দেখেনি বুঝতে পারলাম। বুঝলাম ওরা নেমে গেল। নীচ থেকে ‘ফরিদ' বলে ডাক দিল। একজন সৈন্য সাড়া দিয়ে দৌড়ে নেমে গেল। যেভাবে ছিলাম সেভাবে শুয়ে থাকলাম কিছু সময়। এক সময় কার্নিশ থেকে উঠে আবার লেট্রিনে ঢুকলাম এবং সেখান থেকে উত্তর বাড়ী, তার সামনের