পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩৪৭

 সেখান থেকে আমাদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন দিকে নিয়ে গেলো লাশ বয়ে আনতে। আমাদের অংশটিকে নিয়ে গেলো ডং গুহ ঠাকুরদা যে কোয়ার্টারে থাকতেন সেই দিকে। সেই বিল্ডিং-এর সিঁড়ির কাছে অনেকগুলি লাশ পড়ে ছিল, সিঁড়ির কাছে এনে গুলি করেছে বোঝা গেল। একটি লাশ দেখলাম সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরা, মাথায় টুপি, পাতলা চেহারা। সেখান থেকে নিয়ে গেলো দোতলা, তিনতলা ও চারতলায় লাশ বয়ে আনতে। প্রতিটি তলায় ওরা খোঁজ নিচ্ছিল কোন জীবিত প্রাণী আছে কিনা। আর খুঁজছিল দামী মালামাল, ঘড়ি, সোনাদানা ইত্যাদি। চারতলায় একটি রুমে ঢুকতে পারছিল না। কারণ রুমের দরজা বন্ধ ছিল ভিতর থেকে। দরজা ওরা ভেঙ্গে ফেলল। ঢুকে কাউকেই পাওয়া গেল না। কতকগুলি এলোমেলো কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্র ছাড়া কিছুই ছিল না সেখানে। একজনকে ছাদে উঠে কালো পতাকা ও স্বাধীন বাংলার পতাকা নামাতে বলল। পতাকা নামিয়ে আনলে মিলিটারীদের একজন নিয়ে নিলো সেগুলো। আমাদের নীচে নামতে বলল। নীচে নামলাম আমরা। সিঁড়ির কাছের লাশগুলি নিতে বলল। অনেক লাশ রাস্তায় আগেই জমা করা ছিল। বয়ে আনা লাশগুলিও জড়ো করলাম এগুলির পাশে। পরে নিয়া গেলো ঐ বিল্ডিং এর সামনে দোতলা বাংলো বাড়ীটিতে (তখনকার এস এম হলের প্রভোস্টের বাড়ী)। সামনে দিয়ে ঢুকতে না পেরে পিছন দিয়ে ঢুকলাম ঐ বাড়ীতে। নীচতলা, দোতলার সবগুলি রুমেই খুঁজলাম। এলোমেলো কাপড়-চোপড় সুটকেস, বাক্স, খোলা ফ্যান ছাড়া কিছুই দেখা গেল না সেখানে। মিলিটারীরা দামী জিনিসপত্র খুঁজে খুঁজে নিয়ে নিলো। কোন লাশ কিংবা রক্তের দাগ ছিল না ঐ দালানে। নেমে আসলাম আমরা সবাই এবং জড়ো হলাম আবার লাশের কাছে। মিলিটারীরা কালো পতাকা ও স্বাধীন বাংলার পতাকা পোড়ালো।

 আমাদের আবার লাশ নিতে বললো। রাস্তা দিয়ে সোজা উত্তর দিকে অধ্যাপক গোবিন্দ দেবের বাসার সম্মুখ দিয়ে ইউওটিসি বিল্ডংয়ের সামনের জগন্নাথ হলের মাঠের পূর্ব দিকের ভাঙা দেওয়াল দিয়ে ঢুকতে বলল। হলের মেইন বিল্ডিংয়ের সামনে শহীদ মিনারের সংলগ্ন লাশগুলির কাছে জড়ো করতে লাগলাম লাশগুলি। লাশ যখন নিচ্ছিলাম তখন দেখলাম ডঃ দেবের বাসা থেকে বের করে নিয়ে আসছে সেলাইর মেশিন ও অন্যান্য ছোটখাটো রাস্তার তিন মাথায় অনেকগুলি মর্টার চতুর্দিকে তাক করে রেখেছিল।

 দুজন তিনজন করে আমরা এক একটা লাশ বহন করছিলাম। কোন জায়গায় বসলে কিংবা ধীরে হাঁটলে গুলি করার জন্য তেড়ে আসছিল। সব সময়ই আমরা গা ঘেঁষে বসছিলাম ও চলছিলাম।

 কতগুলো লাশ এভাবে বহন করেছি মনে নেই। শেষ যে লাশটা টেনে ছিলাম তা ছিল দারোয়ান সুনীলের। তার শরীর তখনও গরম ছিল। অবশ্য রৌদ্রে থাকার জন্যও হতে পারে। লাশ নিয়ে মাঠের মাঝামাঝি যেতেই হঠাৎ কতকগুলি মেয়েলোক চিৎকার করে উঠলো দেখি মাঠের দক্ষিণ দিকের বস্তিটির মেয়েছেলেরা মাঠের দিকে দাঁড় করিয়েছে গুলি করার জন্য। এই সব সুইপারদেরই ব্যাংকের কাছে আমাদের থেকে আলাদা করে মাঠে নিয়ে এসেছিলো ওরা। সুইপারদের গুলি করে মারছে আর ঐ ছেলেমেয়েরা চিৎকার করছে এবং ছুটে যেতে চাচ্ছে ওদিকে। বুঝলাম এবার আমাদের পালা। আমাদের আগে যারা লাশ নিয়ে পৌঁছেছিল তাদেরও দাঁড় করিয়েছে॥ তাদের মধ্যে একজন খুব জোরে জোরে শব্দ করে কোরআনের আয়াত পড়ছিল। ব্যাংকের কাছে যখন বসে ছিলাম তখন জেনেছি এই ছেলেটি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। কিশোরগঞ্জে ছিলো তার বাড়ী। আগের দিন বিকালে আর এক বন্ধুসহ এসে উঠেছিল তার হলের এক বন্ধুর রুমে। গুলি করল তাদের সবাইকে। আমরা কোন রকমে দুজনে লাশটা টানতে টানতে নিয়ে এসেছি। সামনেই দেখি ডঃ গোবিন্দ দেবের মৃতদেহ। ধুতি পরা, খালি গা। ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত সারা শরীর। পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার সাথে যে ছেলেটি লাশ টানছিল সে গবিন্দ দেবের লাশটি দেখে বলল ‘দেবকেও মেরেছে! তবে আমাদের আর মরতে ভয় কি? কি ভেবে, আমি দেবের লাশের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে সুনীলের লাশসহ শুয়ে পড়লাম। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা থাকার অবস্থা তখন আমার ছিল না। চোখ বুজে পড়ে থেকে ভাবছিলাম এই বুঝি লাথি মেরে তুলে গুলি