পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

w:yყyტ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড ইসপ্লিন্টারের প্রচণ্ডতা এত বেশী ছিল যে, আমি কখন ফ্লোরে পড়েছি, তা বুঝতে পারিনি। আমার উপর দিয়ে পরপর আরো তিনটে শেল নিক্ষেপ করা হয়। তারপর সব নিস্তব্ধ। দ’টো দেয়ালের কোণে আমি পড়ে ছিলাম। আঘাতে পশ্চিম দিকের দেয়াল উড়ে গেছে-বাইরে থেকে সবই দেখা যায়। আমার উপর বাথরুমের একটা কপাট, দেয়ালের ইট পড়ে আছে। ঠিক কত মিনিট পর জ্ঞান ফিরে পেয়েছি, জানি না। শার্ট ও প্যান্টের অনেক অংশ উড়ে গেছে, চোখে চশমা নেই, সমগ্র শরীর ইটের গুড়োতে লাল হয়ে আছে। পড়ে থাকা অবস্থাতেই হাত-পা নেড়ে দেখলাম কোন হাড় ভেঙ্গেছে কি না। বাঁ পাটা উঠাতে পারলাম না-একটা অংশে অনবরত রক্ত ঝরছিল। শররীরের অনেক স্থানে আঘাতের ব্যথা বেড়ে উঠতে লাগল। ভাবলাম, জল্লাদরা শেল নিক্ষেপ করেই যে ক্ষান্ত হবে, তা নয়। ক্লাবে “শক্রপক্ষের” অবস্থান সম্পর্কে সন্দেহ করলে পরবর্তীকালে উঠে এসে স্টেন দিয়ে ব্রাস করে যাবে। আমি বা পাটা টেনে টেনে বাথরুমের পেছনের দরজার দিকে গেলাম। তখন ভোর হয়ে গেছে। কিন্তু শহরের সর্বত্রই ব্যাপক গোলাগুলী চলছে। শহরে কাফু চলছিল জানতাম না। সিড়ি বেয়ে নীচে নামার পরই ক্লাবের বিপরীত দিকের কোয়ার্টার থেকে দারোয়ান খয়ের এসে আমাকে ক্লাবের ডাইনিং রুমে নিয়ে যায়। আমি সেখানে ফ্লোরে এসে বসলাম, সমস্ত শরীর রক্তে ভেজা। খয়ের ছুটে গেল একটা লুঙ্গি আনতে আমার জন্যে। কিন্তু পনের মিনিটের মধ্যেও সে ফিরে আসল না-ক্লাবের পশ্চিম কোণে তখন সৈন্যরা ঢুকেছে। তার বিলম্ব দেখে আমি এটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। আমার পা টেনে টেনে পেছনের দরজা দিয়ে রান্না ঘরের পাশে গেলাম-সেখান থেকে পুকুরের পাশে সেক্রেটারিয়েটের দেয়াল ঘেষে যে গলিটা গেছে সেখানে উপস্থিত হলাম বিধবস্ত অবস্থায় । দশ বারোজন ছোট দোকানদার ও রিক্সাচালকদের আশ্রয় পুকুরের ধারের এই ঘরগুলোতে। কয়েকজন আমাকে ধরে নিয়ে একটা চৌকির নীচে লুকিয়ে রাখল। ইতিমধ্যে প্রেসক্লাবে আর তার পাশের সরকারী বাড়ীর মধ্যে সৈন্যেরা প্রবেশ করেছে। আমি সেই ঘর থেকে স্পষ্ট ওদের দেখতে পারছিলাম। একজন বুড়োকে বললাম: আপনারা এখান থেকে পালান। একটু পরেই আক্রমণ হবে। বুড়ো: যাবো কোথায়? সারারাত তো এখানেই ছিলাম-আর রাস্তা বন্ধ করেছি ব্যাটাদের। সব গাড়ি থামাতে হয়েছে ওদের, কাউকে বিনা বাধায় যেতে দেইনি। কিন্তু এখন তো দিন আসছে, সব দূর থেকে দেখা যাবে, বললাম। পালানোর চাইতে প্রতি আক্রমণের আগ্রহই তাদের মধ্যে প্রবল। জনৈক যুবক, হয়তো কোন দোকান কর্মচারী, সারাত কিভাবে হানাদার সৈন্যদের সন্ত্রাসের মধ্যে রেখেছিল তার বর্ণনা দিল। প্রেসক্লাবের পেছনের অংশে প্রতিবারই তারা আশ্রয় নিয়েছে হনাদারদের তাড়া খেয়ে সাংবাদিকদের এই প্রেসক্লাবের উপর আক্রমণের কারণটা তখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এই সমস্ত বীর প্রতিরোধকারীদের কোন সন্ধান তারা করতে পারেনি-তাদের উপর আঘাত হানাও সম্ভব হয়নি। এই আক্রোশেই ইয়াহিয়ার সৈন্যরা প্রেসক্লাবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল-তোপের মুখে প্রেসক্লবাবটা উড়িয়ে দিয়ে গেরিলাদের স্তব্ধ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সারারাত অন্ধকারের মধ্যে যে গেরিলারা তাদের সন্ত্রাসের মধ্যে রেখেছিল তাদের ধ্বংস করার জন্যে নিকটস্থ আশ্রয় কেন্দ্রে প্রেসক্লাবে শেল বর্ষণ অস্বাভাবিক কিছু নয়।