পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৪০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○br○ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড এপ্রিল মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা সেখানেই থাকি। ৫ তারিখে আমরা জানালা দিয়ে দেখলাম আমাদের প্রতিবেশী রেলের চীফ ইঞ্জিনিয়ার মোজাম্মেল চৌধুরী, একাউন্টস অফিসার আব্দুল হামিদ, এল, আর খান, এবং তাদের পরিবারের চাকর বাকর নিয়ে মোট ১১ জনকে জবাই করে হত্যা করা হলো। সকাল ১১টায় এই হত্যালীলা দেখে আমরা অতিকে উঠলাম। সেদিনই পালিয়ে গিয়ে উঠলাম ২০ নং চৌধুরী নাজীর আহমদ রোড, ডা: সামসুল আলমের বাড়ীতে। সেখানে থাকাও আমাদের নিরাপদ ছিল না। তাই ডাক্তার সাহেবের পরামর্শে পালালাম তার ডাবুয়ার্গ এর বাড়ীতে। ১১ মে পর্যন্ত সেখানে আমরা থাকি। মেসেস কামরুন বলেন, এই ১১ মে আমাদের জীবনে ডেকে আনলো দু:খের অমানিশা। আমাদের হাতের অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ায় আমার স্বামী একটি চেক ভাংগানোর জন্য ডাক্তার সাহেবের ছেলেকে পাঠান চট্টগ্রাম। রেলওয়ে বিল্ডিং-এস ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের শাখা অফিসে তার একাউন্ট ছিল। কিন্তু সেখানকার কর্মচারীরা সবাই ছিল অবাঙ্গালী। চেকের দস্তখত দেখে তারা ছেলেটিকে আমার স্বামীর খোঁজ দিতে বল। কিন্তু চেকের ব্যাকডেট এর অজুহাত দেখিয়ে ছেলেটি কিছু জানাতে অস্বীকার করলে তারা রেলওয়ে ওয়াচ এণ্ড ওয়ার্ড-এর অবাঙ্গালী অফিসার ওয়াসীকে ডেকে আনে। ওয়াসী তখন ছেলেটিকে ও তার বাবা ডা: সমসুল আমার স্বামীর সন্ধান বের করে। তারপর দুজন খান সেনাকে সংগে নিয়ে ওয়াসী রাউজানের ডাবুয়া গ্রামের ডাক্তার সাহেবের বাড়ীতে গিয়ে হাজির হয়। তারা আমার সামনে থেকে আমার স্বামীকে নিয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হয়। তাদের সঙ্গে ডাক্তার সাহেব ও তার ছেলেও ছিল। পথে ডাক্তার ব্রিজের কাছে বাস থামেয়ে খান সেনারা আমার স্বামীকে নামিয়ে খানিক দূরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই গুলির শব্দ পান বাসে উপবিষ্ট ডাক্তার সাহেব। মিনিট দশেকের মধ্যে খান সেনারা ফিরে আসে এবং ডাক্তার সাহেবকে চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। আমার স্বামীকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে ডাক্তার সাহেব আমাকে জানান। মিসেস কামরুন নাহার তারপর এসে উঠলেন ঢাকাতে। অনেক অনুসন্ধান করে স্বামীর সন্ধান পাননি। দসু্য সেনাদের হাতে নাসিরউদ্দিন শহীদ হয়েছেন। সদা কর্মব্যস্ত বাঙ্গালী দরদী একটি জীবনের অবসান হলো। জীবন দিয়ে নাসিরউদ্দিন মূল্য দিলেন তার দেশ ও স্বজাতি প্রেমের। তিনি আর এই সুন্দর পৃথিবীতে ফিরে আসবেন না। কিন্তু রেখে গেলেন বিধবা কামরুন, আর স্নেহের দুটি ছোট্ট মেয়ে রিনু আর নিডদুকে। অভিশপ্ত ১১ই মেতে তাদের জীবনে নেমে এলো অমানিশার নিকষ কালো রাত্রি । মে থেকে একে একে ৮টি মাস কেটে গেল। বীভৎস রজনীর অন্ধকার জেতে দশদিক আলোয় ঝলমল করে স্বাধীনতার সূর্য উঠলো। শহীদ নাসিরউদিনের স্বপ্নসাধ সফল হয়েছে। মুক্তির সোনালী আলোতে রিনু আর নিডছুর জীবন সুন্দর হবে, সার্থক হবে, এটাই বিধবা মার একমাত্র সান্তনা। কিন্তু এই সান্তনার মাঝেও মিসেস কামরুন নাহারের একটি মাত্র আক্ষেপঃ জল্লাদেরা একটি বারও তার লাশটি দেখতে দিল না। পুলের ধারে না মেরে তারা যদি আমার সামনেই তাকে হত্যা করত আমি তো লাশটা পেতাম।