পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৪১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ֆի, Տ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড আর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পূর্বমুহুর্তে ১২ই ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের কোন এক সময়ে রংপুর বার-এর বিশিষ্ট আইনজীবী একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী রংপুর জেলা ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্রী শিবেন মুখাজীকে সম্ভবত: হত্যা করা হয়েছে। শেষ দিকে তিনি দিনাজপুরে জেলে ছিলেন । ১১ই ডিসেম্বর তাকে মুক্তি দেওয়ার নাম করে দিনাজপুর জেল থেকে বের করে আনা হয়। তারপর আর শিবেন বাবুর কোন খোঁজ মেলেনি। কত যে বধ্যভূমি গোটা জেলায় প্রতিটি শহরে মহকুমায়, থানায় আনাচে কানাচে, কত যে বদ্ধভূম আছে তার অন্ত নেই। বিশ, পঁচিশ, পঞ্চাশ নয়, যেখানে শত শত এমনকি হাজার হাজার লোককে মেরেছে এমন বধ্যভূমিগুলির মধ্যে উল্লেখ করার মত রংপুর শহরও সদর মহকুমার নবিরহাট, জাফরগঞ্জের পুল, নিশবেতগঞ্জ, শাশান ঘাট (রংপুর শহরের কাছে) সাহেবগঞ্জ এবং রংপুর শহরের কাছে মডার্ন সিনেমা হলের পিছনে এবং দেবিপুর। এসব এলাকায় মানুষের হাড়গোড় অসংখ্য পড়ে আছে। ভাল করে খনন করা হলে শত শত নয় হাজার হাজার মানুষের কংকাল খুঁজে পাওয়া যাবে। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে কুকুরণের বিলে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

এ ছাড়া গাইবান্ধা শহরের হেলাল পার্ক, লালমনির হাট, শহর, এবং সৈয়দপুরে হাজার হাজার নিরস্ত্র অসহায় মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। সুন্দর গানুর এলাকা থেকে বহু ঘরের মা, বোনদের ধরে এনে পাশবিক লালসা চরিতার্থ করে হত্যা করা হয়েছে। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত উত্তম নামক স্থানের রিক্সাচালক আহাব উদ্দিন মডার্ন সিনেমা হলের পিছনের একদিনের হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। গত নবেম্বর মাসের ৮ তারিখে আমি যখন রংপুর রেলষ্টেশনে আমার রিক্সার খোঁজ পাই তখন জুম্মাপাড়া নিবাসী পাক বহিনীর জনৈক দালাল আমাকে ন্যাপের কর্মী হিসাবে দুষ্কৃতকারী ও মুক্তি ফৌজ বলে পাক বাহিনীকে সনাক্ত করে দেয়। তখন পাক বাহিনীর জোয়ানরা আমাকে আটক করে রংপুর মর্ডান হলে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে ১৪ দিন আটক করে রাখে। আটক অবস্থায় পাঞ্জাবী পুলিশ আমার দু’হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে আমাকে অমানুষিক অত্যাচার করে। তের দিন পর আমাকে ও আমার সাথে আটক আরো ১৩ জন লোককে যথাক্রমে লালমনির হাটের এক ক্ষত্রিয়মেয়ে, জিনকি, মালেকা, গাইবান্ধার আলী হোসেন, ফারুক, পলাশবাড়ীর আশরাফ আলী, রংপুর উপশহরের রিক্সাচালক আলী ও অন্যান্য সবাইকে রাত্রি ১০ টার সময় মডার্ন হলের পিছনে নিয়ে যায়। আমার সামনে তিনজন পাঞ্জাবী পুলিশ (এদের মধ্যে আজমল খান নামক এক সুবেদার পরে মুক্তিবাহনীর হাতে নিহত হয়েছে) পরপর পাঁচজনকে যথাক্রমে জিনকি, মালেকা, আলী হোসেন, ফারুক ও আর একজনকে যার নাম জানে না আমার সামনে জবাই করেছে। তখন আমি অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে প্রাণভয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করি এবং পরে সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাই। যখন আমি মডার্ন হলে আটক ছিলাম তখন সেখানে ৩৪০ জন লোক ছিল। তাদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়েছে তা বর্ণনা করা যায় না।