পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৪৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Տbr বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড ছিল রুমাল দিয়ে বাঁধা আমাকে মেজর বললো, এ-দেখো। এরপর কড়া মেজাজে হুকুম হলো-আভি তোম যাও। আমি মেজর জাকীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি বটে, কিন্তু ঐ রক্তমাখা ভাইটি বেঁচে আছে তিনা জানি না। শেষের দিকে (বগুড়া ছাড়ার পূর্বে) ওরা রেলওয়ের বাঙ্গালী কর্মচারীদের হত্যা কারারও ষড়যন্ত্র করেছিল। রেলষ্টেশনের আশপাশে নিরীহ বাঙ্গালীদের হত্যা করেও ওদের রক্ত পানের তৃষ্ণা তখনও মেটেনি। বগুড়া ছাড়ার পূর্বে ওদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হওয়ায় আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু রেলষ্টেশনের বধ্যভূমিতে হারিয়ে যাওয়া ভাইরা আর আসবে না। রেলষ্টেশনে সুইপার দশন (৭০) জমাদার সতর্কতার ইঙ্গিত দিয়ে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু এই যুদ্ধের ৭টি মাস কেটে গেছে ষ্টেশনের আশপাশের মৃত বাঙ্গালীদের কবর দিতেই। দশীন জমাদার বগুড়া রেলওয়ে ষ্টেশনের একজন সুইপার। বয়স প্রায় ৭০ বছরের বেশী। এই বৃদ্ধ তার সাতটি মাস কাটিয়ে দিয়েছে বর্বর পাক দস্যদের হত্যা করা লাশ সরিয়ে। দসু্যদের হত্যাযজ্ঞের সে একজন নীরব সাক্ষী। “আমি পূর্বে আরো মোটাসোটা ছিলাম স্যার। আমি লাল টক টকে ছিলাম। কিন্তু বগুড়া ষ্টেশনের আশপাশের বাঙ্গালী ভাইদের রক্ত দেখে দেখে আমি খুব রোগা হয়ে গেছি। আমার শরীরে আগের মত মাংস নেই। আপনিই বলুন, একজন মানুষ শত শত রক্তমাখা লাশ সরালে আর কি করে বাঁচার আশা রাখে। জীবন নিয়ে খেলা হয়েছে সাহেব। আপনারা কিছুই জানেন না। আমি কেমন করে বেঁচে আছি জানি না-ওরা কত জবাই রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে প্রায় ৩০০ গজ দক্ষিণে একটি বদ্ধ কূপ দেখাতে গিয়ে সুইপার দশীন কথাগুলো বলছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বগুড়া লেওয়ের এস ডি ও সাহেব পরিবারসহ এই প্রথম আসলেন তাঁর বাংলোতে। পাক বাহিনীর আমলে তার বাংলোটা সম্পূর্ণভাবে সামরিক দস্যদের হাতে ছিল। তারা এই দু'তলা বাড়িটি ব্যবহার করতো কসাইখানা হিসেবে। নিরীহ বাঙ্গালীদের পাকদসু্য আর তার সহযোগীরা ধরে আনতো, তারপর এই বাড়ীতে জবাই করা হতো, বাড়ীর সংলগ্ন একটা বৃহৎ কুপে হত্যা করার পর মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হতো। বাড়ীটার আউট কিচেনে সবচেয়ে বেশী হত্যা করা হতো বলে মনে হয়। কারণ এখান থেকে কূপটি মাত্র ২০ গজ দূরে। বাড়ীটার চারিদিকে দীর্ঘ নয় মাসে ঘাস আর জঙ্গলে প্রায় ভর্তি হয়েছিল পাকবাহিনীর সেগুলো পরিষ্কার করতো না। কারণ জঙ্গলের মাঝে এই রকম একটি বাড়ীতে তাদের বাঙ্গালনিধনের নেশা খুবই বেড়ে যেত। শুধু তাই নয়, বর্বর পাক-সেনারা এই বাড়ীটাতে মদ আর জুয়ার আডডাও বসাতো। দিনে রাতে তারা এখানে আসর জমাতো নির্বিঘ্নে। ওদের কেউ বাঁধা দিতে পারে নাই। কতজন বাঙ্গালীর মৃতদেহ এই কূপে ফেলেছো।-” কি আর বলব হুজুর। বিশ্বাস করবেন না! আমার হাতেই কমপক্ষে চার-পাঁচ শত লাশ এই কয়ায় ফেলেছি। জল্লাদরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো হুজুর, আমি কি করি। আমি লাশগুলো পুতে রাখতে চাইতাম। কিন্তু ওরা দেয় নাই। ওরা আমাকে বলতো, তু’ শালা হিন্দু হয়। এইসে দরদ কিউ লাগদো “জানতে চাইলে তোমার সামনেই কি ওরা হত্যা করতো।” বৃদ্ধ বলি চলছিল, “কি বলেন সাহেব! আমাকে ওরা ভয় পেত না। প্রথমে বাঙ্গালীকে ধরে আনতে, তারপর হাত বেঁধে মুখের ভিতর কাপড় গুজে দেয়। এরপর হয় পেটের ভিতর চাকু মারে, না হয় জবাই করে। কোনটার আবার পিছন দিক থেকে ঘাড়ে ছুরি বসিয়ে জবাই করতো। ওদের দয়া নাই। কান্নাকাটি অনুরোধ কিছুই শুনেনি। কত বাঙালী যে কাঁদতো হুজুর, কি করবো। মিলিটারীরা খুশিমত মানুষকে গুলি করতো। তারপর আমাকে বলতো ইছি কি হঠাদো’। আমি বাধ্য হয়ে কাজ করেছি হুজুর। কিন্তু ওরা আমাকেও ছাড়ে নাই। রেল ষ্টেশনের বাঙ্গালীদের আমি আগেই বলতাম তোমরা সরে যাও। আমি ওদের এই দিকে আসতে দেইনি। গোপনে গোপনে আমি অনেক বাঙ্গালী সাহেবকে সাবধান করেছি। কিন্তু মিলিটারীরা এটা জানতে পেরে আমাকে সন্দেহ করে ঘাড়ে রাইফেল দিয়ে মারে। শুধু লাশ সরাবার জন্যই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওরা হুজুর