পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৫১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8br8 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড নিস্তব্ধ নগরী। রাত নিঃঝুম। সাধনা ঔষধালয়ের গেটে প্রহরারত দারোয়ান। রামপাল, ইউসুফ মিস্ত্রি, ভূমিসিংহ, সুরুজ সেই ভয়াল রাতের প্রহরী। সেই থমথমে পরিবেশে হঠাৎ একটি মিলিটারী জীপ এসে থামলো। তখন রাত দুপুর। পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র সৈনিক গাড়ী থেকে নামলো। তাদের সবার হাতে ভারী অস্ত্র। একে একে গেটের তালাগুলো আঘাতে ভেঙ্গে ফেললো ওরা। তারপর কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলী ছুড়লো। দোতলায় যোগেশ বাবু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। সুরুজ পাহারাদারও সন্ত্রস্ত। বর্বরদের বিরুদ্ধে তার বন্দুকটা গর্জন করে উঠলো। পরপর কয়েক রাউন্ড গুলী ছুড়লো সে এলোপাতাড়ি। জল্লাদ খান সেনাদের উদ্যত রাইফেল গজিয়ে উঠল। গুলীর মুহুর্মুহু আওয়াজে রাতে নিস্তব্ধতা যেন ভঙ্গ হলো, সারা এলাকাটা যেন কেঁপে উঠল। উভয় পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ হলো গুলী বিনিময়। সে রাতে খান সেনারা সুবিধা করতে পারলো না। সামান্য একজন অস্ত্রশিক্ষণীয় বাঙ্গালী পাহারাদারের কাছে পরাজিত হলো খান সেনারা। কি যেন ভেবে তারা পালিয়ে গেল। বাঙ্গালী বীর সুরুজ সেই স্মরণীয় রাতেই বাবুকে বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলেছিল। বাবু তখনও তার কথায় কর্ণপাত করেননি। ভেবেছিলেন হয়তো মরতে যদি হয়, জন্মভূমিতেই মরবো। পরদিন সকাল। রাতের সেই ভয়াবহ ঘটনা তখনো চোখের সামনে জুল জুল করছে। সন্ত্রস্ত যোগেশ বাবু ও তাঁর ভীত সহকর্মীরা ঘটনাস্থল দেখতে নিচে নেমে এলেন। সকাল তখন প্রায় সাড়ে সাতটা যোগেশ বাবু নিচে নেমেছেন, সবে গত রাতে খান সেনারা যে ধ্বংসের স্বাক্ষর রেখে গেছে তা অবলোকন করছেন। এমনি সময়ে তিনটি মিলিটারী জীপ কারখানার সামনে এসে থামল। গাড়ীগুলো ভর্তি সশস্ত্র সৈনিক খান সেনা বর্বরদের সাত-সকালে আগমনে বাবু আরো ভীত হয়ে উঠলেন। এক অজানা আশঙ্কায় মনটা যেন দমে গেল তাঁর। যদিও তিনি নাকি কখনো মৃত্যুকে ভয় করেন না। তাঁর সঙ্গী সাথী (সহকর্মীরাও) কেমন যেন মুষড়ে পড়লেন। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন তারাও। জল্লাদ খান সেনারা নিচে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করাল। বর্বরদের কয়েকজন যোগেশ বাবুকে নিয়ে উপরে গেল। উদ্যত রাইফেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ সেদিন কি বলেছিলেন কেউ জানতে পারেনি। এদিকে নিচে সবাই ভাবল এই হয়তো সময়। মোক্ষম সুযোগ। প্রথমে একটি বাড়ীতে সুযোগ বুঝে পালাল ওরা। হয়তো বর্বরদের চোখে পড়েনি। তাই সেদিন তারা কয়েকজন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল। কিন্তু একজন বাঁচতে পারলেন না। যিনি ভালবাসতেন এদেশকে। এদেশের মাটিকে। দেশের জনগণকে। যোগেশ চন্দ্র ঘোষ নিহত হলেন বর্বরদের নিষ্ঠুর সঙ্গীনের খোঁচায়। জল্লাদরা তাদের হিংস্ৰ বেয়নেটের আঘাতে একটা অনন্য জীবনের অবসান এনে দিল। সার্থীরা সেদিন সবাই প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিল সত্যি। কিন্তু ফিরে এসে তাদের মনিবকে পায়নি তারা আর। পরে বর্বর খান সেনারা চলে গেলে অনেকে এসছিল। এসেছিল সহকর্মীরা। পাড়া-পড়শীরা। তাদের প্রাণপ্রিয় যোগেশ বাবুকে একবার দেখতে। না, শ্রদ্ধাভাজন যোগেশ বাবুকে তারা আর দেখতে পারেনি। ওরা যখন দেখতে এসেছে ডোমেরা তখন যোগেশ বাবুর লাশ নিতে এসেছে। সঙ্গীনের ক্ষত চিহ্ন। রক্ত ঝরার ধারা ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে। শুকনো কালো রক্তের মাঝে তিনি পড়ে আছেন। বর্বরা তাঁকে শুধু হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা বাবুর সারা জীবনের অর্জিত সকল ধন-সম্পদ নিয়ে গেছে লুণ্ঠন করে।