পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৫১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8brど বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড জানার কৌতুহলে পেয়ে বসেছিল আমাকে। তবু রাত এগারোটার দিকে আমি, আমির হোসেন আর নজরুল অফিসের পিকআপ কারে রওয়ানা হলাম মগবাজারের দিকে। কিন্তু যাওয়া আর হলো না। তদানীন্তন, গভর্নমেন্ট হাউস (বঙ্গভবন) এর কাছাকাছি যেয়ে থেমে গেল পিকআপের চাকা। প্রসারিত দৃষ্টির সম্মুখে ইট, কাঠ, লোহা-লক্কড়ের বেরিকেড। দশ হাত অন্তর সমস্ত পথ জুড়ে এ অবস্থা। আর ইতঃস্তত চঞ্চল চরণের ভিড়। কারো হাতে লোহার ডান্ডা, কারো বা বাঁশের লাঠি। এ ডান্ডা আর লাঠি দিয়েই মানুষ জঙ্গীশাহীর দানবদের রোধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মনে মনে ভাবলাম এ কি সম্ভব? আধুনিক মারণাস্ত্রের সম্মুখে লাঠি সম্বল করে তিষ্টে থাকা কি অকল্পনীয় নয়? তবু মনে মনে আনন্দিত হলাম এ ভেবে যে, সত্যি বাঙ্গালী আজ জেগেছে। সেখান থেকে গাড়ী ঘুরিয়ে আমি ফিরে এলাম অফিসে কিন্তু আমির হোসেন আর নজরুল ফিরলেন না। শ্রীচরণ ভরসা করে তারা চলে গেলেন যে যার গন্তব্যস্থলে। অফিসে ফিরে সিরাজ ভাইর নিচের তলার ঘরটিতে যেয়ে দেখি ঘর শূন্য। তিনি চলে গেছেন উপরে বার্তা বিভাগীয় কক্ষে। সেখানে তখন অস্বাভাবিক অবস্থা। সকলেই কলম তুলে বসে আছেন। দলে দলে লোক আসছে-যাচ্ছে, বেশীর ভাগই তরুণ। তাদের চোখে মুখে ভীতি মিশ্রিত জিজ্ঞাসা। খবর পেলাম মহাখালীর দিকে নাকি মিলিটারী এগিয়ে যাচ্ছে। আর একজন তরুণ প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে এসে বললেন, এই মাত্র খবর পেলাম, মিলিটারী ইকবাল হল ঘিরে ফেলেছে। সেখানে গোলাগুলি চলছে। আপনারা কিছু জানেন কি? আমরা তাদের মতই উড়া খবরের কথা বললাম। সিরাজ ভাই তাদের যার যার ঘরে চলে যেতে পরামর্শ দিলেন। মুহুর্মুহু টেলিফোন আর সংবাদ সংগ্রহেচ্ছক লোকজনের আগমনে ইত্তেফাক অফিস চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু সে মাত্র স্বল্পক্ষণের জন্য, রাত বারোটা বাজতেই বহির্জগতের সাথে আমরা সম্পূর্ণ যোগাযোগ হারিয়ে ফেললাম। এতক্ষণ যে টেলিপ্রিন্টারের শব্দ হচ্ছিল তা স্তব্ধ হয়ে পড়ল, ছিন্ন করে দেওয়া হলো টেফিফোন যোগাযোগ। আমরা তখন আটটি প্রাণী অপেক্ষা করছি চরম মুহুর্তের জন্য। রাত গভীর হতে শুরু করল। আর সে গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়ে নিকট হতে নিকটতর হতে লাগল মেশিনগানের কর্ণবিদারী শো-শো গর্জন, অসহায় মানুষের প্রাণফাটা আর্তনাদ, মাতা, ভগ্নি, জায়ার সকরুণ বিলাপ ধ্বনি। ঢাকার বুকে শুরু হল নারকীয় তাণ্ডবের উন্মত্ত লীলা। এরই মধ্যে আমরা নীচের ক্যান্টিন থেকে এক টিন টোষ্ট বিস্কুট আর অফিস পিয়ন আমিরের দোকান থেকে আনিয়ে নিলাম কয়েক প্যাকেট সিগারেট। মৃত্যু যতক্ষণ না তার হিমশীতল বক্ষে টেনে নিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত একটা কিছু খেতে হবে। এমনি প্রাণান্তকর উৎকণ্ঠা আর মেশিনগান ও ষ্টেনগানের গর্জনের ভেতর দিয়ে রাত শেষ হয়ে এল। আবছা অন্ধকারে ঢাকা রাজধানীর রাজপথের চেহারাটা দেখার জন্য প্রভাত রজনীর অবস্থা অন্ধকারের অবগুঠনে ঢাকা সাবেক গভর্নমেন্ট হাউসের দিক থেকে তখন ছুটে আসছে একটি সামরিক জীপ। সিরাজ ভাই আর রেজা ভাই ভাবলেন, জীপটা বোধ করি ইত্তেফাকের মোড় দিয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু নিমিষে তাদের সে ধারণা টুটে গেল। সম্বিত ফিরে পেতে দেখলেন সিরাজ ভাই দ্বিতলে মেঝেতে পড়ে গেছেন। আর তারই পাশে রক্তাক্ত দেহ শামছু, আমাদের কেন্টিন বয়। মেশিনগানের শিশার বুলেট ডান কানের নীচে দিয়ে গণ্ডদেশ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু জীবন তখনও স্পন্দনহীন হয়ে পড়েনি। কে যাবে ডাক্তার ডাকতে? কোন ডাক্তার আসবে এ সময়। আমরা কয়টি প্রাণী অশ্রুহীন অবাক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলাম নিরপরাধ শামছুর মৃত্যু। কিন্তু এখানে রুদ্ধবাক বিস্ময়ের শেষ নয়। একজন ছুটে এসে বললেন নীচে আমাদের গেইটের সামনে একটি প্রাণহীন রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। সুযোগ বুঝে এক সময় আমরা অজ্ঞাত পরিচয় সে ব্যক্তির মৃতদেহ নিয়ে এলাম অফিসের আঙ্গিনায়। সে একজন হকার। তার পকেটে তখন আশিটি টাকা, হাতে হাতঘড়ি, আর একটা সাইকেল। কে জানে এই আশিটা টাকাই তার পরিবার-পরিজনের অন্নবস্ত্র সংগ্রহের মূলধন কিনা।