8bra বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড বেলা অনুমান ১০টার দিকে (২৬শে মার্চ) অনেক কষ্টে এ বাড়ীর ও বাড়ীর উপর দিয়ে সামছুর মৃতদেহ পাঠানো হলো গোপীবাগ মসজিদে। কিন্তু নাম না জানা হকার ভাইটির মৃতদেহ পাঠানো সম্ভব হল না। জীবানানুভূতি বলতে যা বুঝায় কিছুই তখন নেই। সিরাজ ভাই তখন শুধু মাঝে মাঝে আক্ষেপ করছেন, ‘হায় বাচ্চাকাচ্চাদের দেখে যেতে পারব কিনা কে জানে। সাড়ে দশটার দিকে একটি বিশেষ শব্দে আমরা চমকিত হয়ে উঠলাম। রেজা ভাই বললেনঃ “এটা ট্যাঙ্কের শব্দ।” পূর্ব দিকের জানালার ফাঁক দিয়ে উকি মেরে দেখলাম-হ্যাঁ তাই। তিনটি ট্যাঙ্ক মতিঝিল রোড হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গন্তব্যস্থল সম্ভবতঃ রাজারবাগ। সেখানে কি হত্যাযজ্ঞ চলছে? হানাদার পশুর দল কোন কোন এলাকাকে ধ্বংস স্তুপে পরিণত করেছে কিছুই তার জানার বা বুঝার উপায় নেই। শুধু অভিসার সিনেমা হল আর গোপীবাগের মোড়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে মানুষজন নজরে পড়ল তিন চারটি পশু সিনেমা হলের পশ্চিম দিকের একটি প্রাচীর ঘেরা বাসার প্রাচীরের ওপর উঠে ভেতরে মেশিনগানের গুলী বর্ষণ করছে। রেজা ভাই সাবধান করে বললেন, খবরদার কেউ বাইরে তাকাবে না। বাইরে থেকে দেখতে পেলে আর রক্ষা নেই। রক্ষা প্রকৃতই ছিল না। কারণ লক্ষ্য করেছিলাম রাজপথে কোন বেরিকেড কিংবা কাক পাখীর চিহ্ন না থাকলেও কতক্ষণ পর পরই মেশিনগান থেকে ইত্তেফাকের উপর গুলী বর্ষণ করা হচ্ছিল। এ যেন নিম্প্রাণ জড় পদার্থের উপর জাত-ক্রোধ মেটানো। মেশিন গানের গুলীর চোটে ইত্তেফাকের পশ্চিম দিকের জানালার শাশী ঝন-ঝন করে ছিটিয়ে পড়ছিল। আর সে সাথে আমরা ক’জন কখনও আশ্রয় নিচ্ছিলাম টেবিলের তলায়, আবার কখনও বা আলমারী-টালমারীর তলায়। জীবন মৃত্যুর এ লুকোচুরি খেলায় জঠর জুলার কথা স্বভাবতই মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু মনে করিয়ে দিলেন প্রেসের কয়েকজন কর্মী বন্ধু। হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠে এসে তারা বললেন পাশের বাসা থেকে কিছু ভাত আনবার ব্যবস্থা হয়েছে। কে জানে আরও কতকাল এমনিভাবে থাকতে হবে। আপনারাও দুমুঠো খেয়ে নিন। কিছুক্ষণ পর উক্ত কর্মী বন্ধুটি একটি এলুমিনিয়ামের পাত্রে করে ভাত দিয়ে গেলেন তরকারী আনতে। কিন্তু সে যাওয়াই তার শেষ যাওয়া হল। তিনি আর তরকারি নিয়ে ফিরে আসতে পারলেন না। নীচে থেকে ভেসে আসল সুপারী কলে যে বিশেষ ধরণের শব্দ হয় তেমনি শব্দ। পরে বুঝেছি সে শব্দটা আর কিছুই নয়, তালা ভাঙ্গার শব্দ। সে শব্দ শেষ না হতেই আবার ভেসে আসল সেই পরিচিত আওয়াজ। দেখলাম একটা ট্যাঙ্ক এসেছে। দাঁড়িয়েছে ইত্তেফাক অফিসের পশ্চিম দিকের মোড়ে। তারপর আর দেখতে হল না। বিকট এক বোমার আওয়াজের সাথে সাথে থরথর করে কেপে উঠল ইত্তেফাক ভবন। মাটির পুতুলের মত ঝরে পড়ল টেলিফোন একচেঞ্জ কক্ষটি। আমরা উন্মাদের মত লুটিয়ে পড়লাম মেঝেতে। এ ভাবে কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। মনে হল রেজা ভাইর হাঁক ডাকে, চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে বললেন, দেখতো ধুয়া দেখা যাচ্ছে কি না। সঙ্গে সঙ্গে একজন পশ্চিম দিকে সরে এসে তাকালেন নীচে এবং জানালেন মেশিন ঘরে আগুন দাউ দাউ করে জুলছে। অপার্থিব একটা ভরসা এসে দানা বেঁধেছিল। মনে হচ্ছিল, নিশ্চয় বাঁচব। ওরা আমাকে মারতে পারবে না। ভাবে? বার্তা বিভাগ ও হিসাব রক্ষা বিভাগের মাঝখানে একটা ছয়-সাত ফুট উচু পার্টিশান ওয়াল। স্থির হল, পাটিশানটা ডিঙ্গিয়ে হিসাব রক্ষা বিভাগে প্রবেশ করতে হবে। তারপর সেখানে লিফটের জন্য সংরক্ষিত গর্ত পথে নামতে হবে দেড় তলায় অবস্থিত জব সেকশনে। এবং জব সেকশন থেকে পেছন সিড়ি দিয়ে নেমে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে পাশের বাড়ীতে। আমার জানি তখন কেমন মনে হল যে, স্যাণ্ডেল পায়ে এভাবে যাওয়া সম্ভব নয়। সঙ্গে সঙ্গে স্যাণ্ডেলগুলো বার্তা বিভাগে রেখে দিয়ে একে একে আমরা গেলাম হিসাব রক্ষা বিভাগে।