পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৫১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8b-br বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড আগুনের লেলিহান শিখার তাপ তখন আমাদের গায়ে এসে লাগছে। কিন্তু সেদিকে আমাদের কারো ক্ৰক্ষেপ নেই। হিসাব রক্ষা বিভাগে এসে আমি আর ইয়াহিয়া বখত লিফটের গর্ত দিয়ে লাফিয়ে পড়লাম নীচে। কিন্তু বিধি বাম। জব সেকশনের দরজা জানালা বন্ধ। প্রাণপণ শক্তিতে টানাটানি করেও যখন খোলা সম্ভব হল না আবার দেয়াল বেয়ে সেই গর্ত পথে উঠে এলাম হিসাব রক্ষা বিভাগে। আজ ভাবি কেমন করে এটা সম্ভব হয়েছে? এখন কি আমার দ্বারা সম্ভব ! পেছনের দরজা দিয়ে পালাবার চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর আমাদের সামনে রইল দুইটি বিকল্প, এক আগুনে আত্মাহুতি দান এবং দুই, জীবন বাজী রেখে ভেতরের সিড়ি পথে পালানোর চেষ্টা। উকি মেরে দেখলাম, মেশিনগান হাতে দুইটি মানুষ জন্তু সাক্ষাৎ যমদূতের মত ইত্তেফাকের সামনের দিকের ছোট্ট খোলা আঙ্গিনায় পায়চারী করছে। তবু কি আর করা যায়। হামাগুড়ি দিয়ে আমরা আটজন হিসাব রক্ষা বিভাগ থেকে আসলাম ঢাকা টাইমস-এর অফিসে এবং তারপর সেখান থেকে হামাগুড়ি দিতে দিতে ভেতরের সিড়ি দিয়ে নামলাম নীচে। সদ্য আমদানীকৃত ইত্তেফাকের মেশিন ঘর থেকে আগুন তখন ছড়িয়ে পড়েছে অস্থায়ী ঘরগুলোর মেশিন ঘরে। তারই ভেতর দিয়ে প্রায় উন্মাদের মত আমরা ছুটে গেলাম দেওয়ালের দিকে। তারপর সে ছ’ফুট দেয়াল পলকে অতিক্রম করে প্রবেশ করলাম পাশের বাড়ীতে দেখলাম, প্রেসের কর্মী ভাইয়েরা আগেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। পাশের বাড়ীর ছোট ছোট মেয়ে-ছেলেগুলো তখন প্রাণফাটা চীৎকার করছে। গৃহকর্তা পশ্চিমের ঘরটার বাঁশের বেড়া খুলে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কারণ, আগুন তখন ইত্তেফাক অফিসের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। ঠিক মনে নেই কে একজন যেন বললেন, আপনারা এখান থেকে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ওদিকে চলে যান। বুঝলাম, ইত্তেফাকের কর্মী ও সাংবাদিক আমরা, তাই এত ভয় তারপর আবার শুরু হল দেয়াল টপকানোর পালা। একের পর এক দেয়াল টপকিয়ে আমরা চারজন এলাম পূর্বদিকে আর অবশিষ্ট চারজন চলে গেল অন্যদিকে। সিরাজ ভাই হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা পেলেন। আমার ডাক পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেকে তখন অঝোর ধারায় রক্তপাত হচ্ছে। ইত্তেফাকের তদানীন্তন ড্রাইভার করিম আমাদের দেখতে পেয়ে তার সাথে আরও কিছুটা নিয়ে গেলো। রেজা ভাই বললেন, ব্রাহ্মণ চিরণের কাছে আমার ছোট ভাই বেণু থাকে। সেখানে যেতে পারলে রাতটা কাটানো যাবে। বলা বাহুল্য, তখন ২৬ শে মার্চের সন্ধ্যা। সব পথ আমাদের জানা ছিল না, করিম এগিয়ে এলো সাহায্যার্থে। এ বাড়ী ও বাড়ী এ গলি ও গলির ভেতর দিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম গোপীবাগের পূর্বদিকস্থ রেল লাইনের ধারে দূর থেকে তখন ভেসে আসছে মুহুর্মুহু মেশিনগানের গুলীর আওয়াজ। রেল ষ্টেশনের নির্মাণাধীন ওভার ব্রীজের উপর দণ্ডায়মান জল্লাদ ইয়াহিয়ার মানুষ জন্তুর বাহিনীর দুজন রোজ গার্ডেনের দিকে অবিরাম গুলী ছুড়ছে। ঝন ঝন করে উঠছে টিনের ঘরগুলো। তারই ভিতর দিয়ে ময়লা ও বিষ্টায় সংকীর্ণ রেল লাইনের ঢালু দিয়ে রাতের আবছা আঁধারে আমরা হামাগুড়ি দিতে দিতে যেয়ে উঠলাম ব্রাহ্মণ চিরণের বেনু সাবের রাস্তায়। রাতে ঘুম হল না। এদিকে গুলীর আওয়াজ, মানুষের আর্তচীৎকারে আর অন্যদিকে বাসার চিন্তা। ২৭ তারিখে আটটায় ঢাকা বেতার থেকে ঘোষিত হল “সকাল সাতটা থেকে সান্ধ্যআইন তুলে নেওয়া হয়েছে।” আমরা বেরিয়ে এলাম। চলে গেলাম যে যার বাসার দিকে। সেদিনই সিরাজ ভাইর সাথে আবার দেখা করেছি। দেখতে এসেছি ইত্তেফাক-এর ধ্বংসস্তুপ আর বিধ্বস্ত নগরীর অবস্থা। পথে পথে লক্ষ্য করেছিশত শত নিরীহ নিরপরাধ মানুষের মৃতদেহ সিরাজ ভাইর বড় আশা ছিল তার নোট বইয়ে তুলে রাখা এসব ঘটনা তিনি একদিন না একদিন ব্যক্ত করবেন। কিন্তু কে জানত সে আশা তার পূর্ণ হবার নয়।