পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৫১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

85Տ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড মারা অন্যায়। আমার অপরাধের বিচার একমাত্র সামরিক আদালতই করতে পারে।” প্রশ্ন করলেন, “একজন আর্মি কর্নেল একজন ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে সে মর্যাদা পেতে পারে, আমাকে দেওয়া হচ্ছে না কেন?” কিন্তু এ নরপিশাচদের কাছে সকল যুক্তিই বৃথা গেলো। সিংহ-হৃদয় মহাপুরুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন, হাত থেকে খুলে দিলেন ঘড়ি, পকেট থেকে বের করে দিলেন নিজের ও কলেজের চাবি যা এতোদিন ছিল তার দায়িত্বে। নিজের চোখে দেখলেন একজন সিপাই তারই চোখের সামনে থেকে তারই ঘড়ি তুলে নিয়ে নিজের হাতে পরে ঘড়ি পরা হাতটা কেমন লাগে তাই-ই লোলুপ দৃষ্টিতে নেড়ে চেড়ে দেখছে। দেখলেন জোয়ানরা উল্লাসের সাথে তার দামী জিনিসপত্র ও কলেজের মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাকে তুলছে। এই মহাপুরুষের কোন ভাবান্তর হলোনা, আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলেন না, করলেন না করুণা ভিক্ষা, অমূল্য ধনপ্রাণ ভিক্ষাও চাইলেন না। শুধু চাইলেন পাঁচ মিনিটের সময়। তারপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন বাংলোর সামনের লনে। বসলেন গিয়ে গোলাপ গাছের পাশে, কি যেন বিড় বিড় করে পড়লেন, বোঝা গেল না-শুধু ঠোঁট নড়া দেখে বোঝা গেল, তারপর হাত তুলে আল্লাহর কাছে যেন কি ফরিয়াদ করলেন, মোনাজাত শেষ করে বললেন, I am ready এরপর কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা, নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো গুড়ুম গুড়ুম গুডুম তিনটে আওয়াজ। নরপিশাচ মানব জাতির কলঙ্ক ইয়াহিয়ার সৈনিক ইকবালের ষ্টেনগানের তিনটি গুলী এক এক করে এ পবিত্র দেহে বিদ্ধ হলো। শরীরটা ঢলে পড়ল। আর শোনা গেল একটি মাত্র ক্ষীণ স্বর, “মা আয়েশা, তোমাকে দেখে যেতে পারলাম না।” এরপর প্রাণভরে লুটে নিল কলেজের দামী দামী জিনিসপত্র, বাধা দেবার কেউ রইল না। তারপর তারা যখন উল্লাস করতে করতে ২ নম্বর গেট দিয়ে বের হচ্ছিল সে সময় তাদের নজর পড়লো গেটে কর্তব্যরত মালী সাত্তারের উপর। তাকে তারা ধরে নিয়ে ড্রেনের পাশে দাঁড় করিয়ে পর পর দুটো গুলী করে হত্যা করলো। গুলী দুটো তার দেহ ভেদ করে দেয়ালে বিদ্ধ হল। তার দেহ এলিয়ে পড়লো ড্রেনের মধ্যে। এত করেও ওরা শান্তি পেল না। আশেপাশের গ্রামে খুঁজতে লাগল কলেজের চাকুরে কে কোথায় আছে। এমনি এক গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে আসল হতভাগ্য চৌকিদার সইজদীনকে। তাকে ধরে নিয়ে এসে কলেজের সামনে ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া সড়কের পুলের তলায় দাঁড় করিয়ে গুলী করল। তার প্রাণহীন দেহ পুলের তলায় পানিতে পড়ে গেল। এমনি কত জানা অজানা লোকের রক্তের স্রোতের উপর ভেসে স্বাধীনতার তরী আমাদের কাছে নতুন জীবনের সাওগাত নিয়ে এসেছে। এদের রক্ত বিফল যায়নি। যেতে পারে না। কেননা স্বাধীনতার রক্তকে উন্নত ও সজীব রাখতে সারের প্রয়োজন হয়। আর সে সার হচ্ছে অত্যাচারীর ও অত্যাচারিতের তাজা উষ্ণ লাল রক্ত।