পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৫২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8b○ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড হতো। এর সবই বাসু মিঞাকে বহন করতে হতো। তাছাড়া যখন বাড়ীতে আসে তখন তো গোশত পোলাও চা মিষ্টি, কফি, কলা, রয়েছেই। শুধু বন্ধুত্বের জন্যই এসব করেননি, প্রাণের ভয়েও করেছেন। কেননা আর বাঙ্গালী যাদের কাছে গাদ্দার, শত্র বাসু মিঞা তখন বাঙ্গালী হয়ে তাদেরই অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাই এমন খাতির করাটার চেয়ে না করাটাই অস্বাভাবিক। এরই মধ্যে একদিন আমি নিজে ধরা পড়ে গেলাম খান সেনাদের হাতে। রাত তখন নয়টা। আমার অপরাধ যুবক বাঙ্গালী এবং মুক্তি ফৌজের সন্দেহে আমাকে নিয়ে গেল। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে অনেক পেলাম ঠিকই কিন্তু আমার শরীর থেকে রক্ত বের করে নিল যথেষ্ট পরিমাণে। এছাড়াও রংপুর মডার্ন হলের পিছনে যে বীভৎস দৃশ্য দেখেছি তা বলতেও শিহরণ জাগে। বেশ বড় একটা আগাছার বন তারই মধ্যে লেপ, কাঁথা, বালিশ তোষক পাটে পাটে সাজান, এ গুলো ধর্ষণ বা নারী সঙ্গমের শয্যা। পাশেই বেশ বড় একটা অত্যধিক ধর্ষণের গর্ত পড়ে। যেসব মেয়েরা, মা-বোনেরা সঙ্গমে অপারগ হয়ে পড়তো, অক্ষমতা প্রকাশ করতো তাদেরকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে এই গর্তের মধ্যে ফেলা হত। এদেরকে কুকুরে খেত, পোকা মাকড়ে খেত। দেশী ও বিদেশী সাংবাদিকগণ মেপেজুকে হিসাব করে বলেছিলেন এ গর্তে প্রায় চার-পাঁচশ মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। উক্ত গর্তের মধ্যে তাদের এলোমেলো চুল, লম্বা বেণী গাঁথা চুল, ছায়া, শাড়ী, সালোয়ার, কামিজ, মাথা, খুলি, আধাপচা গোস্তসহ পোকা ঘিন ঘিন করা মাথা, এসব নিজে দেখেছি নেড়েচেড়ে দেখেছি। মডার্ন হল ছিল উচ্চপদস্থ খানদের ক্যাম্প। শুনেছি- সেখানে নাকি কয়েক ঝুড়ি শুধু ভাঙ্গা কাঁচের চুড়ি পাওয়া গেছে। তবে নিজে দেখেছি মডার্ন হলের দেয়াল ঘেষা ইন্দারার পাশে যে কুল গাছটি আজও হত্যার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার ডালে লটকানো ফাঁসির দড়ি, আশে-পাশে ছেড়া রক্তমাখা কিছু কিছু ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার, শাড়ীর পাড় এবং টুকরো টুকরো ব্যাণ্ডেজ আকারের অনেক সাদা কাপড়। কুল গাছটা যদি আজ কথা বলতে পারতো তবে নিশ্চয় জানা যেত কতটা অসহায় নারীকে ধর্ষণ শেষে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তার ডালে। সেদিন একাত্তরের তিরিশে মে-র দিনগত একত্ৰিশে মে-র রাত। রংপুর ক্যান্টনমেন্টে নাচগানের বড় আয়োজন। খানসেনারা এসে রোজকার মত গাড়ী করে নিয়ে গেল বাসু মিঞাকে। সঙ্গে গেল তার শালা হবিবর রহমান, ওরফে চাঁদু। এই চাঁদুকে মিলিটারিরা দোস্ত বলে ডাকতো, এসেই হাত মেলাতো, কেলি করতো। কিন্তু সেদিন রোজকার মত ঠিক সময়ে বাড়ী ফিরতে না দেখে স্ত্রী, মা, কন্যা, ভাইবোন সবাই চিন্তা আর শঙ্কার মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। রাত তখন ঠিক সাড়ে এগারটা। সারা রংপুর শহরে সান্ধ্য আইন থম থম করছে। ঠিক এই সময় সম্ভবতঃ ষড়যন্ত্রমাফিক দু’খানা জীপ গাড়ী ভর্তি পাকসেনা এসে ঘিরে ফেলল বাসু মিঞার বাড়ী। ব্যাপারটা সম্যক অনুভব করে বাসু মিঞার কনিষ্ঠ ভগ্নিপতি মিঃ নুরুল ইসলাম আকন্দ যুবতী বাসু কন্যা জ্যোৎস্না এবং অন্যান্য যুবতী বেীদের পাশের বাড়ীতে সরিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীর টপকিয়ে আর গেট ভেঙ্গে ছয়-সাত জন সেনা ঢুকে পড়লো। ঢুকেই পেল বাসু মিঞার ছোট ভাই গেদু আর ভাগ্নে জুলুকে বেঁধে ফেলল ওদের হাত আর চোখ। মুখে-শালা, বাহেনচোত খিঞ্জিরাকা বাচ্চা তুম জয় বাংলাকা আদমি হ্যায়, বাতাও বাসু মিঞা কিধার হ্যায়। ধড়াস করে মারল রাইফেলের বট দিয়ে গেদুর ঘাড়ে। গেদু চোখ বাঁধা অবস্থায় মা বলে ডেকে উঠে পড়ে গেল। ঠিক এমনি সময়ে আর একটা গাড়ী এসে দাঁড়ালো বাড়ীর গেটে। বাসু মিঞা আর চাঁদুকে নামিয়ে দিয়েই মুহুর্তের মধ্যে গাড়ীটা হুঙ্কার দিয়ে বেরিয়ে গেল। রোজ তারা বাড়ীর মধ্যে যেয়ে চা পানি পানের পর যেতো কিন্তু আজ গেলো না। এটা যে এইভাবেই ধরি মাছ না ছুই পানি ষড়যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে কাজ হাছিল করা হচ্ছে তা নিশ্চয় দুর্বোধ্য নয়। বাড়ীর মধ্যে চাপা কান্না আর আওয়াজ শুনতে পেয়ে চাঁদু ছুটে এসে প্রবেশ করে অন্দরে, ঢুকে দেখে রোজ যারা এসে