পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৫৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○8○ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড শুকোচ্ছে। চাদর বা তোষক এই ক' দিনের মধ্যে আর শুকোয় নি। তার ওপরেই শুতে হচ্ছে, কারণ মাটি তো আরো ভিজে কাদা-কাদা। সবচেয়ে কষ্ট তো বাচ্চাগুলোর। ওখানেই তিনটের খুব জুর। আমরা এগোতেই পরিবৃত হয়ে গেলাম। আমরা কি সরকার থেকে আসছি? ওদের যে এখনও টিকেট হয়নি। টিকেট না-হলে তো ডোলও পাবে না। অথচ ম্যাডিকেল হয়ে গেছে। কলেরার ইনজেকশন আর বসন্তের টীকা, দুই-ই। সঙ্গে রয়েছে সেই কাগজ। কিন্তু টাকীর কোন ক্যাম্পেই তো আর নতুন লোক নেওয়া হচ্ছে না। -আমাদের একটা টিকিট করায়ে দ্যান বাবু। অন্ততঃ কয়েক দিন চালডাল দ্যান। তারপর যেখানে পাঠেইবেন সেখানেই যাব। টিকিট করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা থাকলে তখুনিই দিতাম বৈকি। ওরা ক’দিন চাল-ডাল পেলে তার পরেই যদি অন্য কোথাও চালান হতে চায়, সেও তো খুব ভালো কথা। গাছতলা ছেড়ে, পশ্চিম বাংলার বাইরে যে-কোন মাথা গোজবার ঠাইই ওদের কাছে প্রিয়তর। যখন পূর্ব বাংলার ভিটে ছাড়তে পেরেছে, তখন পশ্চিম বাংলার গাছতলাটার জন্যেই বা মায়া কিসের? কিন্তু দেশে ফিরবে না? না, দেশে আর ফিরবে না। কোথায় ফিরবে? যা কিছু ছিল লুটে নিয়েছে। যখন লুটে নিলো তার পরেও তো ছিল কিছু দিন। লুটপাটে বাধা দিতে গিয়ে মার খেয়েছে। হারাধন মণ্ডলের হাঁটুতে আর কোমরের কাছে এখনও বল্লমের খোঁচার দাগ। তবুও ছিল। কিন্তু যখন ঘরে আগুন দিলে, মেয়েদের ধরে টানতে লাগল, ছেলেদের ধরে কাটতে লাগল, তখনও কি আর থাকা চলে? কিন্তু যদি আওয়ামী লীগ সরকার করে তা হলেও ফিরবে না? তা হলে ফেরা যায়, কিন্তু এখন কোথায় আওয়ামী লীগ বাবু? এখন তো সবাই মুসলিম লীগ। আরো খানিক এগিয়ে বা দিকে সৈন্যের বাগান ক্যাম্প। সামনে মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটির নিশান৷ এই ক্যাম্পে প্রায় সাতাশ হাজার নারী-পুরুষ-শিশু। হিন্দু-মুসলমান-ধৃষ্টান। খৃষ্টান পরিবার গোটা চারেক। মুসলমান পরিবার আটশর বেশী। ওরা থাকে ওধারে। এদিকে হিন্দুর। বর্ণ হিন্দু নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ খুলনা জেলার বেশির ভাগই চাষবাষ করত। একজন বললে, তার জমি ছিল ৬২ বিঘে। এখন সঙ্গে আছে শুধু খাজনার রসিদ। দলিলটা সঙ্গে করে আনতে পারেনি। তবে রসিদটা রেখেছে। যদি কখনও ফেরে তবে দাবি করতে পারবে জমিটা-এই রকম আশা এখনও বুকের ভেতরে। এখানে মাথাপিছু বরাদ্দ ৪০০ গ্রাম চাল, ১০০ গ্রাম ডাল আর ১০০ গ্রাম আলু-পেয়াজ। ছ’দিনের রেশন এক সঙ্গে বিতরণ করে মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি। মাঝে একটা বড় পুকুর। আর গোটা নয়েক নলকূপ। সরকারী কর্মচারীদের ওপর চাপ খুব, কিন্তু এখনও ঐ শিবিরে কোন বড় রকমের রোগ দেখা দেয়নি, এই যা রক্ষা। এই ক্যাম্পের জমিটাও একটু উচু। ফলে জল দাঁড়াতে পায় না। তবে স্বাস্থ্যরক্ষার বন্দোবস্ত এমন নয় যে খুব নিশ্চিন্তে থাকা যায়। বিশেষতঃ বর্ষা বাড়লে। যারা শিবিরে ঠাই পায়নি তাদের দেখে আসার পর মনে হতে পারে এখানে এরা যেন সুখে আছে। মাথার ওপর ত্রিপল, রোদ, খাবারের বাঁধা বরাদ্দ। তবে জালানির অভাব। তাই খিচুড়ি ফুটিয়ে নেওয়াই রেওয়াজ। শিবিরে প্রথম দিনটি অবশ্য অনেকের কাছে বিপদের। অনেকটা পথ অর্ধাহারে-অনাহারে হেঁটে এসে অনেকেই প্রথমে লোভের বশে অনেকটা খেয়ে ফেলে। পেট এই অনিয়ম সহ্য করতে পারে না।