পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

II বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড ll Σ Ο Il মোহাম্মদ সালেহুজ্জামান সাব ইন্সপেক্টর অব পুলিশ রমনা থানা, ঢাকা ১৯৭১ সনের ২৫মে মার্চ সন্ধ্যায় আমি এক প্লাটুন ফোর্সসহ মীরপুর এক নম্বর সেকশনে টহলে ছিলাম। সন্ধ্যার পরপরই আমি মিরপুরের সর্বত্র থমথমে ভাব লক্ষ করেছি। রাত আনুমানিক সাড়ে দশটার সময় আমার ওয়ারলেস সেটটি অকস্মাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ওয়্যারলেস সেটে এক বাঙ্গালী পুলিশ কষ্ঠ অজানা ষ্টেশন থেকে বলছিল, “ঢাকা সেনানিবাস থেকে ট্যাঙ্ক ও কামানবাহী সশস্ত্র পাকসেনাদের ট্রাক সারিবদ্ধভাবে রাজধানীতে সদৰ্পে প্রবেশ করছে, বাঙ্গালী পুলিশ তোমরা সাবধান হও” ইহার পর আমার ওয়্যারলেস সেটের মারফত ঢাকা পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে মেসেজ দেওয়া হয়, “পুলিশ ডিউটি উইথড্রন”। ওয়্যারলেস দেখলাম। অকস্মাৎ রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ইকবাল হল, ই,পি, আর হেডকোয়ার্টারে ভীষণ কামান ও ট্যাঙ্ক হামলার আকাশফাটা শব্দ শুনতে পাই। এ পরিস্থিতিতে আমি আমার টহলরত পুলিশ ফোর্সকে মিরপুরের পশ্চিম দিকে গ্রামের দিকে চলে গিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ করার নির্দেশ দিয়ে আমি আমার রাইফেল ও গুলি নিয়ে থানার বাসায় চলে যাই। থানায় ফিরে এসে আমি তৎকালীন মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার মিঃ আবুল হাসেম এবং অন্যান্য সাব ইন্সপেক্টর, এ, এস, আই ও বাঙ্গালী পুলিশদের অত্যন্ত বিমর্ষ ও বিমূঢ় দেখতে পাই। থানায় বসে আমরা ওয়ারলেসে বাঙ্গালী কষ্ঠের বহু বীভৎস আর্তনাদ শুনতে পাই রাত সাড়ে চারটার দিকে পাক পশুরা পুলিশ কন্ট্রোল রুম দখল করে সেখানকার ওয়ারলেসে বাইরে টহলে নিযুক্ত বাঙ্গালী পুলিশদের কর্কশ কষ্ঠে বলছিল “বাঙ্গালী শালালোগ, আভী আ-কার দেখো, তোমারা কেতনা মা বাহেন হামারা পাস হায়......।” একথা শুনে আমাদের বাঙ্গালী পুলিশদের গা শিউরে ওঠে। আমি তৎক্ষণাৎ ওয়্যারলেস সেট বন্ধ করে দেই। সকাল হওয়ার পূর্বেই আমি থানা ও থানার বাসা ছেড়ে দিয়ে মিরপুরে অন্য এক বাসায় আত্মগোপন করে থাকি। সকালে আমি দেখলাম বাঙ্গালী ই, পি, আরদের মিরপুর ই, পি, আর ক্যাম্প থেকে বন্দী করে আমাদের থানার সম্মুখে এনে পাক-পশুরা নিরস্ত্র করে থানায় বন্দী করছে। আমি আরও দেখলাম মিরপুরের সকল বাঙ্গালী বাড়ীতে বিহারীরা কপালে সাদা কাপড় বেঁধে দানবের মত উল্লাসে ফেটে পড়ে আগুন লাগাচ্ছে, লুট পাট করছে। বাড়ী বাড়ী থেকে বাঙ্গালী শিশু যুবতী বৃদ্ধাদের টেনে এন রাস্তায় রাস্তায় ফেলে ছোরা দিয়ে জবাই করছে, বাঙ্গালী রমণীদের ধরে এন রাস্তায় উলঙ্গ করে ফেলে উপযুপরি ধর্ষণ করে তৎক্ষণাৎ ধারালো ছুরি দিয়ে স্তন ও পাছার মাংস ছলাৎ করে কেটে ফেলে নৃশংসভাবে হত্যা করছে। কাউকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলছে, কারও যোনিতে লোহার রড ঢুকিয়ে দিচ্ছে, কারও গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। ভীতসন্ত্রস্ত হাজারো মানুষ তখন প্রাণভয়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। যে সকল নিরীহ মানুষ পালাতে পারছিল না তাদেরকে বিহারীরা নির্মমভাবে জবাই করছিল। পাক সেনারা এ ব্যাপক বাঙ্গালী হত্যায় বিহারীদের পিছনে থেকে সাহায্য করছিল। ২৭শে মার্চ সকালে কিছুক্ষণের জন্য কার্ফ তুলে নিলে আমি আমার পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মিরপুরের বাইরে যাত্রা করি। মিরপুর গরুর হাট অতিক্রম করার সময় আমি দেখলাম পাক সেনাদের টহল ভেদ করে একটি ট্রাকে মহিলা ও শিশু মিরপুর ব্রীজের দিকে যাচ্ছিল- পাক সেনারা ঐ ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর দুটি যুবতী মেয়েকে তাদের জীপে উঠিয়ে নিয়ে যায়। মেয়ে দুটি পাক পশুদের হাতে পড়ে প্রানফাটা চিৎকারে আর্তনাদ করছিল। আমরা দূর থেকে গরুর হাট বরাবর বোরো ধানের ক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। বহু দুর্দশা ও লাঞ্চনা ভোগ করে আমি আট দিন পায়ে হেঁটে ও নৌকাযোগে দেশের বাড়ীতে পৌঁছি। স্বাক্ষর/মোঃ সালেহুজ্জামান 어-S- 8