পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

U.S. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড চায়। তাছাড়া উপহাস যা করছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমাকে শ্বশুরবাড়ী পাঠাচ্ছে ওরা। সেখানে নাকি জয় বাংলা জয়গান শুনা যাবে ইত্যাদি। মনটা তিতিয়ে উঠলো ওদের ব্যাবহারে কিন্তু করবার আমার কি আছে? ক্যাপ্টেন শামশাদের ৭৫ জন পাক বাহিনীর একটা দল সাতে স্থানীয় আল বদর বাহিনী ও তাদের তাঁবেদার দালালবৃন্দ। এই নরপিশাচদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া একটা বন্দী মানব সন্তানের পক্ষে সম্ভব কি না তা আপনারাই বিবেচনা করুন। কোন মুহুর্তে অবস্থার কি পরিবর্তন আসবে আমি তা ঠাওর করতে পারলাম না। ক্রমে ওরা আমাকে নিয়ে চলে চান্দ দিঘির রেল সেতুর উপর এসে পৌছল। ওরা আবার এক দফা আমার হস্তের বন্ধন পরীক্ষা করে নিল। মানুষ সাগরে ডুবতে গিয়েও তৃণখণ্ডকে আশ্রয় করে বাঁচতে চেষ্টা করে একথা পুথি পুস্তকে পড়েছিলাম। ষোল আনা বিশ্বাস করতে পারিনি। পুলের উপর এসেই আমার কেন যেন মনে হলো পুলের নীচে ঐ অতল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচবার চেষ্টা করা যায় নাকি কি করব মনস্থিও করতে পারলাম না। ক্যাপ্টেন শামশাদ আমার পার্শ্বে চলছে, পুল পার হয়ে গেলাম, পশ্চিম পাশ্বেই মোজাম্মেল হোসেন তালুকদার সাহেবের বাড়ী। ওরা দুই ভাগে হলো, হঠাৎ পণ্ডিত বাড়ীতে একটা ফাঁকা গুলি হলো। তাদের অগ্রগামী দলটি ঐ বাড়ীতে ঢুকে পড়ল। পিছনের দলটি মাটিতে শুয়ে পড়ল রেল লাইনে। আমাকেও শুইয়ে দিল মাটিতে। কিছুক্ষণ পর ওরা ফিরে এলো তালুকদার বাড়ী হতে। মোজাম্মেল হোসেন তালুকদারকে ওরা ধরতে পারেনি। আমি নিজের অসহায় অবস্থার মধ্যেও কিছুটা তৃপ্তি পেলাম, যেহেতু তালুকদার সাহেব আমার অবস্থায় নিপতিত হননি। আবার যাত্রা হলো শুরু দক্ষিণ দিকে। বেশী দূর নয়; পুটিয়ার পাড় গ্রামে এসে ওরা থেমে পড়ল। আবার শুয়ে পাড়ল মাটিতে। আমাকে শুইয়ে দিল মাটিতে। কয়েকজন গেল মতিলাল রায়ের বাড়ীতে। ওদের লোক মতিলাল বাবুর বাড়ী থেকে ফিরে এসে কি যেন জানাল। রেল লাইনে কয়েকজন মেশিনগান ফিট করে পাহারায় রাইল। বাদবাকি সবাই চলল মতি বাবুর বাড়ী। ক্যাপ্টেন শামশাদ আমাকে নিয়ে গেল তার সাথে, মাতি বাবুর বাড়ীর সামনে এসে সবাই আবার শুয়ে পড়ল মাটিতে, আমাকে শুইয়ে দিল। কয়েকজন চলে এলো এদিকে এবং মতিবাবুর বাড়ীর মধ্যে। মাতিবাবুর বাড়ীতে কাউকে ওরা পেল না। পাশের বাড়ী হতে ধরে নিয়ে এলো একটি যুবককে। ওকে আমি চিনতাম, ওর নাম রাধা। রাধাকে যখন নিয়ে এলো তখন ওর গলা লেপটে ধরে ছিল ওর একমাত্র মাতৃহারা শিশুকন্যাটি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকেইে ও মেয়েটিকে মাতৃস্নেহে পালন করছিল। রাধার ঠাকুর মা বুড়ীর এই মর্মান্তিক ঘটনা অবলোকন করার জন্য বেঁচেছিল, বুড়ী রাধার সাথে মতিবাবুর বাহিরাঙ্গিনায় এসে হাজির হলো। ক্যাপ্টেন শামশাদ তখন রাধার নিকট গিয়ে বুকে জড়ানো শিশুটিকে রাধার ঠাকুর মাকে দিতে বলল। রাধা প্রাণপণ চেষ্টা করেও শিশুটিকে তার ঠাকুরমার কোলে দিতে পারলো না। মাতৃস্নেহ হতে বঞ্চিত শিশুটি কিছুতেই পিতৃস্নেহ হতে যেন বঞ্চিত হতে চায় না। তাই সে কোমর বেষ্ট করে পিতার বুকে মিশিয়ে পিতৃস্নেহের অসীম ধারা যেন উজাড় করে নিচ্ছিল। কিন্তু সে মাত্র ক্ষণিকের জন্য। তারপর যে চিত্রের অবতারণা হলো তা মনে করলে আজও আমার সংজ্ঞা লোপ পেতে চায়। তখন আমি পাথরে পরিণত হয়ে যাই। আমার মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে যায়। তবু আমাকে বলতেই হচ্ছে। দুরাচার ক্যাপটেনের ইঙ্গিতে একজন হানাদার সৈনিক রাধার শিশুটির বুকের ফাঁক দিয়ে একটা রাইফেল ঢুকিয়ে এমনভাবে ঝটকা দিল যে শিশু ৭/৮ হাত দূরে ছিটকে পড়ে পা আছড়িয়ে ডুকরে কেদে উঠল। আমার মনে হলো আদিমাতা বিবি হাওয়া যেমতে ছিটকে পড়ছিলেন, বুড়ীটাও হাউমাউ করে কেদে উঠে রাধার শরীর পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন, ক্যাপ্টেন শামশাদ পিছন ফিরে তার বুকের উপর সজোরে লাথি মেরে চিৎপটাং করে ফেলে দিল। তারপর ওখানে কোন পরিবেশের সৃষ্টি হলো তা অবলোকন করার ভাগ্য আমার হয়নি। ওরা রাধাসহ আরও কয়েকজনকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে রেল লাইনে এলা, আমাকেও নিয়ে এলো। লাইনে এসে পুনরায় আমার হাতের বাঁধন পরীক্ষা করে দেখল। আমি এরপর হাত দুটি একটু জোরে অথচ ওরা যেন দেখতে না পায় এমনভাবে ঘসা দিলাম, তাতেই