পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬২ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড শিথিল হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম হাত খসে গেছে, তবু তা বাঁধা আছে এমন ভাবেই রেখে দিলাম। ইতিমধ্যেই ওরা ধরে আনা লোকদের মধ্যে হতে ৪ জনকে লাইন করে বসিয়ে মেশিনগান দিয়ে দু-তিনটি গুলি করল। নিরপরাধ চাটি মানুষ হুমড়ী খেয়ে পড়ে গেল মাটির বুকে। আমি মাত্র ৭/৮ হাত দূরে থেকে এ দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করলাম। তখন আমি প্রকৃতস্থ ছিলাম কিনা মনে নেই। শুধু এই মনে আছে আমার মাতাপিতা, স্ত্রী-পুত্র, কন্যা, আত্মীয়-স্বজন সবাই যেন আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই যেন আমাকে বিদায় দিতে এসেছে আমি যেন মহাশূন্যের অভিযাত্রী। ওরা গুলি খেয়ে ঢলে পড়ল মাটিতে আর আমি তার আওয়াজ শুনে উঠতে থাকলাম শূন্যে। এমনিভাবে কতক্ষণ গিয়েছিলাম মনে নেই পা তুলতে থাকলাম ক্রমাগত কিন্তু পায়ের নীচে মাটি আছে কিনা অনুভব করতে পারলাম না। ওরা আমাকে নিয়ে ফিরে চলল উত্তর দিকে। আমার সাথে আর একজন বাঁধা অবস্থায় এলো। ওকেও আমি চিনতাম। তার নাম কালু। আমরা উভয়ে বন্দী অবস্থায় এগুতে লাগলাম পুনরায় চান্দ দীঘির পুলের দিকে যেহেতু আমরা পূর্বপরিচিত তাই আমাদের মধ্যে পথের মাঝে কোন কথাবার্তা প্রকাশ্যে হয়নি। মনে মনে ভাবলাম মরতে তো হবেই তবু বাঁচবার একটু চেষ্টা করে দেখি না কেন? তাতে ধরা পড়ি যদি তাইে বা ক্ষতি কি? এদের হাতে গেলে জীবন যে ফিরে পাওয়া যায় না তাতে নিশ্চিত ছিলাম তাই ভিতরে ভিতরে বাঁচবার জন্য তৈরী হয়ে নিলাম। সামনেই চান্দদীঘির পুল। আমার জীবন রক্ষার সোপান। পুলের উপর পা বাড়ালাম। হানাদারেরা আমাকে মধ্যে রেখে দুপাশ দিয়ে লাইন করে অগ্রসর হতে লাগল। আমি মিছিমিছিই টলতে লাগলাম। একবার এদিকে একবার ওদিকে পড়ে যাই যেন এমনিভাবে দেখাতে লাগলাম। পুলের দুই-তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে গেল। আমার ইচ্ছার প্রতিফলন করতে পারলাম কই? ঘেমে উঠল সারা গা নিরাশার অমানিশায়। এমন সময় হঠাৎ পুলের পূর্ব পাশ দিয়ে চলার ফুরসত পেলাম। এক পা, দুই পা, তিন পা, আর নয়, সিঁড়িতে পা না দিয়ে শূন্যস্থানে পা দিয়ে শরীর ছেড়ে দিলাম। পড়ে গেলাম পুলের নীচে। যার হাতে আমার হাত বাঁধা রশি ছিল সে আমাকে ধরে রাখতে পারল না। ওরা উপরে কি করছিল তা আমার খেয়াল নেই। আমি ততক্ষণে পুলের নীচে পাকা খাম্বার সাথে দেহটাকে মিলিয়ে আছি। সে মাত্র ক্ষণিকের জন্য পরেই ডুব এক ডুব, দুই ডুব, তিন ডুব দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ গিয়ে মাথা ভাসিয়ে দেখি ওরা টর্চলাইট দিয়ে আমাকে খুঁজছে। টর্চের আলোটা তীক্ষ ছিলনা তাই রক্ষা। ওরাপ পুল পার হয়ে গেল। আমি প্রাণপণে সাঁতরাতে শুরু করলাম। কিন্তু বিপদ যখন আসে তখন একা আসে না। আমার হাত বাঁধা রশিটা এক হাতে বাঁধাই ছিল। সাঁতরাবার সময় সেটা যে বিপর্যয় আনতে পারে তা আদৌ মনে হয়নি। এক্ষণে তা ক্রমাগত আমার উরু বেষ্টন করে সন্তরণ বন্ধ করে দিতে লাগল, এক পা এবং এক হাত বন্ধ হয়ে গেল। ওটা ছাড়াবার জন্য চেষ্টা করে আরও পেরেশান হয়ে পড়লাম। তখন আমি চান্দ দিঘীর মাছখানে অতল জলে। স্রোত নেই; বাঁধা পানি গাও এলিয়ে দিলে শরীর ডুবে যায়। এক হাতে আর এক পায়ে সাঁতরে চলেছি। ওরা দেখতে পেলে যে কোন মুহুর্তে গুলি করে এই চিন্তায় আরও অস্থির হয়ে পড়লাম। পাক বাহিনীর হাত হতে নিস্কৃতি পেয়ে এখন বুঝি সলিল সামাধি রচিত হয়। মনে হতে লাগল, মৃত্যু অবধারিত। পাক বাহিনীর গুলি হতে নিস্কৃতি পেয়েছিলাম সত্য কিন্তু ওদের রশি থেকে বুঝি মুক্তি নেই। খোলা হাত দুটি আস্তে আস্তে নাড়াতে লাগলাম। খোদার নাম জপতে থাকলাম, নিরুপায় সেই অন্তিম মুহুর্তে এখনি হয়ত ডুবে যাব চান্দদীঘির কাজল জলে। হঠাৎ একটা কচুরীপানার চাকা হাতে লাগল। ওরই উপর একটু ভর দিলাম। আমাকে আশ্রয় দিল না ডুবে গেল। আবার পেলাম আর একটা চাকা সেখানে ঐ অবস্থাই ঘটল। তবুও কিছু নিঃশ্বাস কাটার অবকাশ পেলাম। এমনইভাবে ক্রমাগত কচুরী পানার উপর ভর রেখে চান্দ দীঘির পশ্চিমে গিয়ে অবশের মত পড়ে রইলাম। কিন্তু আমাকে পড়ে থাকলে চলবে কেন? আমি বাঁচতে চাই। ওরা যদি আমাকে খালের ধার দিয়ে খুঁজতে আসে। আমি পাশের পাট ক্ষেতের মধ্যে গড়িয়ে পড়লাম। আমার দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। দু তিনবার চেষ্টা করে দেখলাম দাঁড়াতে পারিনে।