পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৫১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

488 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল : চতুর্থ খন্ড জনপ্রতিনিধিদের হাতে নয়। যে শাসনতন্ত্র হবে আইউবী শাসনতন্ত্রের চাইতেও ধোঁকাবাজিপূর্ণ। আর এই ইচ্ছা থেকেই ইয়াহিয়া এদিন তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন। তার এই ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ বটিকা সেবনের জন্য আইউবের দশ বছরের সেবাদাস ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর, ওয়াহিদুজ্জামানের মধ্যে যেমন কাড়াকড়ি পড়ে গেছে, তেমনি কাড়াকড়ি লেগেছে আইউব আমলের গোপন সেবাদাস ফরিদ, খাজা, খয়ের, গোলাম আজম প্রমুখ চামুদের মধ্যে। ইয়াহিয়া আশা করেছিলেন এই চামুদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছু পরিষদ সদস্যকে ধরে-বেঁধে এনে যুক্ত করে তিনি তার পার্লামেন্ট ও সরকার খাড়া করবেন। এই উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছেন, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ১৪ বছর জেলে দিয়েছেন এমন কি তাদের নিশ্চয়তা দিয়ে প্রচারকার্য চালাতে শুরু করেন। কিন্তু সীমান্তে ‘অভ্যর্থনা শিবির’ স্থাপন এবং দালালদের মাধ্যমে অনেক দেনদরবারের পরও দেখা গেছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় সদস্যরা কেউ ইয়াহিয়ার বশংবদ হতে কিংবা তার পা-চাটা কুত্তাদের দলে ভিড়তে রাজী নয়। যে দু’একজন সদস্যকে বন্দুকের নল দেখিয়ে ইয়াহিয়া কয়েদ করেছেন, ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে তারা কি করবেন, সে সম্পর্কে ইয়াহিয়া চক্র নাকি নিশ্চিত নন। ফলে এলো ২৮শে জুনের বেতার ঘোষণা। তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের প্রহসন শিকায় তুলে রেখে ইয়াহিয়া বাধ্য হয়ে বিশ্ববাসীকে তার আসল চেহারা দেখালেন, বললেন, তিনি বিশেষজ্ঞ দ্বারা তৈরী একটা শাসনতন্ত্র দেশকে উপহার দেবেন। অর্থাৎ নিজেই একটা শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন। দেশকে শাসনতন্ত্র দেয়ার নামে আইউব যা করেছিলেন, তার রাজনৈতিক জারজপুত্রেরা তার চাইতে বেশী কি করতে পারেন? ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা চক্রের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রেরই সমুচিত ও সফল জবাব বর্তমান মাসের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ দলীয় উভয় পরিষদের সদস্যদের যুক্ত বৈঠক। এই বৈঠকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সাড়ে পনর আনা সদস্য অংশ গ্রহণ করে একথাই দিবালোকের মত স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক সদস্যকে নিয়ে একটা তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টায় ইয়াহিয়া সফল হচ্ছেন বা হবেন এই প্রচার সম্পূর্ণ মিথ্যা। ইয়াহিয়ার হাতে দু’চারজন বন্দী সদস্য ছাড়া কেউ নেই। বাংলাদেশের প্রকৃত গণপ্রতিনিধিরা রয়েছেন মুক্তাঞ্চলে, প্রকৃত বৈধ সরকার রয়েছে মুজিবনগরে। দসু্য ইয়াহিয়াচক্র অধিকৃত বাংলাদেশে অবৈধ দখলদার মাত্র। বাংলাদেশের মাটিতে অবস্থান করা বা বাংলাদেশের মানুষের নামে কথা বলার কোন অধিকার এই খুনী ও তস্কর-চক্রের নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের নামে কথা বলবে, তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে একমাত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। মুজিবনগরে বৈঠক ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করব এজন্যেই যে, এই বৈঠক বাংলাদেশের মানুষ ও মুক্তি বাহিনীর মনোবল দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের মানুষ জেনেছে তাদের গণপ্রতিনিধিরা রমনায় দশ লক্ষাধিক জনতার সামনে ৩রা জানুয়ারী তারিখে শেখ মুজিবরের নেতৃত্বে যে শপথ করেছিল, সে শপথ তারা ভঙ্গ করেনি বরং অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। আজ মুক্তিবাহিনী জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের যে পবিত্র দায়িত্ব পালন করছে রণাঙ্গনে, সেই একই দায়িত্ব পালন করছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় সদস্যেরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। গণমানুষ ও গণপ্রতিনিধিদের ভূমিকায় আজ আর কোন পার্থক্য নেই। একই প্রতিরোধচেতনা ও স্বাধীনতা কামনায় তারা উদ্বুদ্ধ, অণুপ্রাণিত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মুজিবনগর বৈঠকের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথমতঃ নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের একটা অংশকে ইয়াহিয়া-চক্র হাতে পেয়েছে এবং তাদের যোগসাজশে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের হয়ে কথা বলতে পারে এই দাবী ও প্ররোচনায় সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বের শান্তিকামী গণতন্ত্রী ও মানবতাবাদী দেশগুলোর কাছে আজ এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন এবং স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে তারা কৃতসংকল্প।