পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৭০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

676 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড শিরোনাম সূত্র তারিখ ২৫৪ | সম্পাদকীয় : বাংলাদেশের জন্য | আনন্দ বাজার ৩০ মার্চ, ১৯৭১ বাংলাদেশের জন্য আমরা কি করতে পারি বুধবার পশ্চিমবঙ্গে হরতালের ডাক এই রাজ্যের মানুষের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে। তার কারণ, মানুষ এই মুহুর্তে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সমর্থন প্রকাশ করার জন্য যে গভীর আকুতি বোধ করছেন সেটা এই হরতালের ভিতর দিয়ে রূপায়িত হতে পারে। যদিও একথা বলা যেতে পারে যে, এমন একটা প্রচন্ড আবেগে মথিত উপলক্ষে হরতালের উপযোগিতা নিতান্তই সীমাবদ্ধ, তাহলেও এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, এই হরতালের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনোভাব একটা স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি লাভ করবে। এই হরতালের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে যেখানে কোন বিরোধ নেই সেখানে জনসাধারণের ঐক্য যাতে অটুট থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। এই হরতাল পরিপূর্ণ শান্তির মধ্যে, সম্পূর্ণ বিনা বাধায় উদযাপিত হওয়া উচিৎ। আমরা আশা করি যে, বুধবারের হরতালের উদ্যোক্তারা এ বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে, হরতালের পর কি? এটা কি আদৌ অস্বাভাবিক নয় যে, এই দেশের মানুষ প্রতিবেশী দেশের সংগ্রামীদের বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট সাহায্য দেওয়ার জন্য বলতে গেলে অস্থির হয়ে উঠেছে। এই বাংলাদেশের মানুষগুলি কয়েক বছর আগে আমাদের স্বদেশবাসী ছিল। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের নাড়ীর যোগ রয়েছে। এই জীবন মরণ পরীক্ষার দিনে তাদের প্রতি এদেশের মানুষের হৃদয়ের গভীরতম তন্ত্রগুলি সহানুভূতির সুরে অনুরণিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেকথা ছেড়ে দিলেও, সেখানে যা হচ্ছে সেটা বলতে গেলে ইতিহাসের একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। অসামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সামরিক অভু্যত্থান আমরা দেখেছি, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসামরিক জনতার প্রতিরোধও আমরা দেখেছি, কিন্তু একটা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসামরিক অভু্যত্থান, অসামরিক জনতা কর্তৃক সামরিক শাসনের অধীন রাষ্ট্রযন্ত্র অধিকার, এমন দৃশ্য কে কবে দেখেছে? ভারতের মানুষ ঘরের পাশে বলেই এই ঘটনার তাৎপর্যটা সঠিকভাবে উপলব্দি করছে। সরকারী বিবৃতির মধ্য দিয়ে, লোকসভার সদস্যদের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে, দিল্লীর জনসভার মধ্য দিয়ে, কলকাতার ময়দানের জনসভার মধ্য দিয়ে, বোম্বাইয়ে ও অন্যত্র বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের প্রতি এদেশের মানুষের অভূতপূর্ব মমতা প্রকাশ পেয়েছে। আর সেই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে ঐ সংগ্রামী মানুষগুলির পাশে এসে দাঁড়াবার জন্য, যেভাবে হোক, তাদের সাহায্য করার জন্য একটা গভীর আকুতি। এখন পর্যন্ত এই আকুতি অসংগঠিত ও বাস্তব পরিকল্পনাহীন। সকলেই বুঝছে, একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু ঠিক কি করার দরকার অথবা কতটা করা যায় সে বিষয়ে কারও স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। সেই কারণে পরম্পরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার কোন চেষ্টা না করে যিনি যেমন বুঝছেন তেমনিভাবে কথা বলছেন। কিছু তরুণ উদ্দেশ্যহীনভাবে সীমান্তে গিয়ে ভিড় করছেন, কেউ অনশন করছেন, কেউ পাকিস্তানী দূতাবাসগুলির সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। আসল কথা হল, মানুষের মধ্যে যে আবেগ দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দিয়ে দাঁড়াবার জন্য যে গভীর আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে হরতালের পর একটা সুনির্দিষ্ট, একমুখী কর্মসূচীর মধ্যে সংহত করার পরিকল্পনা নেই, সেই উদ্দেশ্যে তাদের সামনে নেতৃতুও রাখা হচ্ছে না। মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনাকে এভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে দেওয়া শুধু অপচয়কর নয়, ক্ষতিকারকও হতে পারে। এমনকি, এটা পশ্চিমবঙ্গের গতানুগতিক রাজনৈতিক দলাদলির আরেকটি উপলক্ষে পরিণত হওয়াও সম্ভব। এই আগ্রহ-উদ্দীপনা যাতে একটা নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত হয় সেজন্য নেতৃস্থানীয় মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গেই এর বেশী প্রয়োজন। প্রতিবেশী দেশের এই ঘটনা সম্পর্কে নয়াদিল্লিতে ভারত সরকার কি নীতি গ্রহণ করবেন তা আরও কয়েক দিন না গেলে বোঝা যাবে না। সরকারকে অবশ্যই অনেক ভাবনা-চিন্তা করে, চারদিক বাঁচিয়ে তাঁদের নীতি স্থির করতে হবে। তাহলেও বেসরকারী স্তরে মানুষ যদি সরকারী নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেও কয়েক পা এগিয়ে