পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৭৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

767 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তানকেই বেছে নেবে- পূর্ব বাংলাকে নয়। পশ্চিম পাকিস্তানই সত্যিকারের পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা ত’ পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে যাতে সামরিক দিক দিয়ে সংযোগ না ঘটতে পারে, সে উদ্দেশ্যে এ দুটি দেশের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানকে গোঁজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। চীনকে পশ্চিম পাকিস্তান তার প্রথম শ্রেণীর বিপক্ষে বন্দর করাচীকে ব্যবহার করার জন্য দেবে। চীন আজ রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় ঘাঁটি গড়তে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের মাধ্যমে চীন সহজেই ঐ দুটি অঞ্চলে প্রবেশের সুযোগ পাবে। (ঘ) অবশ্য চীন যে তার ভৌগোলিক রাজনৈতিক হিসাবের খাতা থেকে পূর্ব বাংলাকে একেবারে খারিজ করে দেবে, তা নয়। সে পূর্ববাংলার প্রশ্নটিও খোলা রেখেছে। যাতে আওয়ামী লীগেই নেতৃত্ব একই সাথে ভারতের সঙ্গে কলংকিত হয় এটা দেখবার জন্যই চীন অপেক্ষা করছে। মুজিবর রহমান ও তার দল সুস্পষ্টরূপে ভারতের সমর্থক। এবং বাংলাদেশের জনসাধারণও মুখ্যত ভারতের সমর্থক। ইয়াহিয়া খানের নির্মম নিপীড়নে ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি পরাজিত ও কলংকিত হয়, সেক্ষেত্রে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হতাশা ও শূন্যতা দেখা দেবে। তা পূরণের জন্য সেখানে চীনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে আসবে। আর তখন চীন পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে প্রবেশ করতে ইতস্তত করবে না। সে অবস্থায় চীন শুধু পূর্ব বাংলার প্রশ্নেই আবদ্ধ থাকবে না। সম্ভবত: সিকিম, ভুটান, নেপাল ও ব্রহ্ম সমেত আসাম, নেফা, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মণিপুর এবং পশ্চিম বঙ্গকে নিয়ে সারা পূর্ব ভারতে সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার জন্য পূর্ব বাংলাকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ভারত কি এ অবস্থা ঘটতে দেবে? এটা কি ভারতের পক্ষে আত্মহত্যার শামিল নয়? (ঙ) ১৯৬২ সালে নেফায় যেদিন চীন তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে ঢুকেছিল তখন ভারতের প্রতিরক্ষা অবস্থা যা ছিল, তা আজকের দিনের অর্থাৎ ১৯৭১ সালের চীন বনাম ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিচারে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সময় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলতে সত্যিকারের যা বোঝায়, তা ভারতের ছিল না। তাতেও সে সময়ে “থাগলা” ; থেকে ‘ফুট হিলস’ আসতে একমাস লেগেছিল। এখন উত্তরাঞ্চলে শত্রকে রুখবার জন্য পাহাড়ী পরিবেশে যুদ্ধক্ষম আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত নয় ডিভিশন সৈন্যকে ভারত উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে নিযুক্ত করেছে। চীন ভুটানকে আক্রমণ করতে পারব না। ভুটান রাষ্ট্রসংঘের সদস্য। এক্ষেত্রে ভুটান আক্রান্ত হলে বিশ্বের অন্যান্য শক্তিগুলিও জড়িয়ে পড়বে। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজকে বিপুল সাহায্য দেওয়ার উদ্দেশ্যে যদি ভারত হস্তক্ষেপ করে, তাহলে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ পাক-বাহিনীকে নির্মুল করে দিতে পারবে। এরকম অবস্থায় পূর্ব বাংলায় অবস্থিত পাকিস্তানী বাহিনীকে চীন সত্যিকারের কোন সাহায্যই দিতে পারবে না। চীনের পক্ষে ভারতের নয় ডিভিশন সৈন্যের বেড়াজাল ছিন্ন করে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য দেওয়া সহজ হবে না। তাছাড়া, যত বড় শক্তিই হোক না কেন, হিমালয় ডিঙ্গিয়ে ভারতীয় উপত্যকায় প্রবেশ করে কোন শক্তির পক্ষেই যুদ্ধ করা সম্ভব হবে না- যুদ্ধের সরবরাহ পথ এতই বিপদসঙ্কুল ও অনিশ্চিত যে সমর কৌশল প্রশ্নটি অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর তাছাড়া সাধারণত চীনকে যুদ্ধের জন্য অন্য দেশে ঢুকে পড়তে দেখা যায় না। কেবলমাত্র কোরিয়াতে এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল। তবে সেখানেও নিজের প্রতিরক্ষার স্বার্থেই চীন ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিল। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এখনও পর্যন্ত চীন ভিয়েতনামে কোন সশস্ত্র বাহিনী পাঠায়নি। (চ) এখন চীন এবং রাশিয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক বর্তমান, তা হলো প্রকাশ্য বৈরিতার। কিন্তু ১৯৬২ সালে ঐ দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সে রকম সম্পর্ক ছিল না। তাছাড়া সে সময় কিউবায় পারমাণবিক বোমারু বিমানের ঘাঁটি স্থাপনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধ আসন্ন হয়ে উঠেছিল, আর সে জন্য রাশিয়া অনেকাংশে প্রতিহতও হয়েছিল। চীনও সে সময় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে বিপজ্জনক পরিণতির উদ্ভব হয়েছিল, তার সুযোগ নিয়েছিল। এখন সিংকিয়াং থেকে শুরু করে মাংগোলিয়া পর্যন্ত দু'দেশের মধ্যে বিরাজমান সুবিস্তৃত সীমান্ত জুড়ে চীনকে বিপুল সৈন্য বাহিনী নিয়োগ করতে হয়েছে। এটা মনে রাখা দরকার যে, সোভিয়েট-চীন সীমান্ত অঞ্চল পৃথিবীর মধ্যে দীর্ঘতম।