পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৮৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

834 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড শিরোনাম সূত্র তারিখ ৩৪১। ধরা পড়েছে মার্কিন ফাঁকি আনন্দ বাজার পত্রিকা ২৫ জুন, ১৯৭১ সম্পাদকীয় - ধরা পড়েছে মার্কিন ফাঁকি মার্কিন সমর সম্ভার নিয়ে পাক-জাহাজগুলো করাচীর দিকে এগুচ্ছে। সংসদে উত্তেজনা বাড়ছে। সবাই জানে বাংলাদেশের কপালে দুঃখ অনেক। যারা গণতন্ত্র রক্ষায় উৎসর্গিত প্রাণ বলে কথিত তাঁরাই সেজেছেন ভক্ষক। তাঁদের অস্ত্র ব্যবহৃত হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে ভারতের জনসাধারণ ক্ষুদ্ধ এবং রাগে ফেটে পড়েছেন বাংলাদেশের জনতা। শরণার্থীরা প্রতিবাদমুখর । ওরা ঘেরাও করছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পরিদর্শনে। দুর্গত মানুষগুলো বুঝতে পারছে না মার্কিন কর্তৃপক্ষের দ্বৈতনীতি। এদিকে তাঁরা শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশায় চোখের জল ফেলছেন, অপরদিকে বাংলাদেশের দুষমনদের হাতে তুলে দিচ্ছেন মারণাস্ত্র। মানুষ মারার ব্যবসা এবং মানবতার উচ্চগ্রামী নিনাদের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা কঠিন কাজ। ওয়াশিংটনের যুক্তি দুর্বল। তাঁরা প্রতশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আগে কোন মার্কিন অস্ত্র যাবে না পাকিস্তানে দুনিয়ার সামনে নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে, মার্কিন প্রতিশ্রুতি ভূয়া। তার নেই কোন বাস্তব মূল্য। ওঁদের কথায় এবং কাজে ধরা পড়েছে লজ্জাজনক অসংগতি সংসদ সদস্যদের উত্তেজনা খুবই স্বাভাবিক। তাঁদের প্রশ্নবাণে নাজেহাল কেন্দ্রীয় সরকার। সাঝদরিয়া থেকে পাক-জাহাজের মার্কিন সম্ভার তুলে নেবার দাবি জানাচ্ছেন নয়াদিল্লী। অবাস্তব পায়তারা। জ্ঞানপাপীকে জ্ঞানদান অসম্ভব। পররাষ্টমন্ত্রী স্বরণ সিং বিব্রত। কত আশা নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকায়। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে তিনি করেছিলেন আলাপ-আলোচনা। অখন্ড বিশ্বাস নিয়ে ফিরেছেন তিনি দেশে। লিখিত বিবৃতিতে স্বরণ সিং বলেছেন, গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক মার্কিন সরকার সত্যভ্রষ্ট হবেন না। তারপরই হাতেনাতে ধরা পরেছে গণতন্ত্রের মহামান্য সেবকদের কান্ডকারখানা। স্বরণ সিং-এর সার্টিফিকেট প্রকৃতপক্ষে সত্যের অপলাপ। এই লাইন ক’টি বাদ দেবার জন্য সংসদে উঠেছিল দাবি কেটে দিলে হয়ত খুশী হতেন মাননীয় সদস্যরা। কিন্তু তাতে মার্কিন সরকারের টনক নড়ত না। ভারতের দেওয়া সুনাম কিংবা বদনামে তাঁরা থোড়াই কেয়ার করেন। পাক-ভারত শক্তিসাম্য বজায় রাখা তাঁদের নীতি। চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মার্কিন কর্তার করবেন পাক – তোষণ। তাতে যদি গণতন্ত্র কিংবা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ জাহান্নামে যায়, যাক। এ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই আমেরিকার। বলদপিত ধনীদের চিন্তাধারা আলাদা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর হাত-পা তাদের লেজের সঙ্গে বাঁধা। ওরা জানে কিছুক্ষণ ছটফটনির পর গরীবেরা ধর্না দেবে তাদের দরজায়। টাকা পেলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক শালীনতার মাপকাঠি বানাবে তারাই। অবশিষ্ট দুনিয়া মেনে নেবে ওদের নিরূপিত সভ্যতার নিত্যনতুন সংজ্ঞা। বেশি দিন আগের কথা নয়, ১৯৬৫ সালে মার্কিন অস্ত্র নিয়ে আয়ুব খান লাড়াই-এ নেমেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে। তখনও মার্কিন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এসেছিল প্রতিশ্রুতি খেলাপের অভিযোগ। তাতে কান দেবার দরকার বোধ করেনি আমেরিকা। মার্কিন অস্ত্র ইসরাইলে গেলে ক্ষেপে ওঠে আরব দুনিয়া। ওরা বলে এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হবে ইসরাইলী নির্যাতিত আরব হননে। এসব অস্ত্র যখন পাকিস্তানে যায় তখন তারা নীরব। অনেকে নীরব। অনেকে মনে মনে খুশী। একথা তাদের ধারণায় আসে না যে, মার্কিন মারণাস্ত্র প্রযোজ্য হবে বাংলাদেশের বাঙালি হননে। এগুলো ব্যবহার করবেন নরঘাতক ইয়াহিয়া খান। ওরা ভাবে, মুসলমান ইয়াহিয়া নির্বিচারে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান খুন করলে দোষ নেই। যত দোষ ইসরাইল যদি আরব নিধনযজ্ঞ চালায়। বর্তমান দুনিয়ায় একমাত্র আমেরিকাই বিবেক বর্জিত সুবিধাবাদী নয়, অন্যেরাও বড় কম যায় না। দুর্ভাগ্য ভারতের এই স্বাৰ্থদুষ্ট দুনিয়ার মুখের দিকে চেয়ে আছে নয়াদিল্লী। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভারে নুইয়ে পড়ছে তাঁদের অর্থনৈতিক কাঠামো। আকাশে জমা হচ্ছে সামাজিক অর্থনৈতিক বিপ্লবের কালমেঘ। শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরত না পাঠালে নয়। যাঁকে পর্যুদস্ত করলে এদের প্রত্যাবর্তনের পথ হবে।